
রাজনীতিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, 'একটা শব্দের ভুল, আর হাজার কণ্ঠে শোরগোল।' নানা জাতি, নানা মতের ভারতে 'অস্মিতা' একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ। ভারতভূমে প্রতিটি জাতির আবেগ বা জাত্যাভিমান বহু প্রাচীন। ব্রিটিশ আমলেও বহুবার 'অস্মিতা'র রাজনীতির সাক্ষী থেকেছে ভারত। অতঃপর? সাবধানের মার নেই!
উনিশ শতকের গোড়ায় বাঙালির বাবু সংস্কৃতি
বাঙালির বাবু বা দাদা সংস্কৃতিও সেই অস্মিতারই একটি অংশ। যদিও উনিশ শতকের গোঁড়ায় বাংলায় বাবু কালচারের সঙ্গে বিষয়টি গুলিয়ে না ফেলাই ভাল। সেকালে হঠাৎ ধনী হওয়া একশ্রেণির মানুষ, যারা বিলাসে ও অমিতাচারে জীবন ভাসিয়ে দিত, তাঁদের বাবু বলা হত। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রমথনাথ লিখেছেন, ‘যাঁহার চারি প পরিপূর্ণ হইবেক তিনি হাপবাবু হইবেন। প-য়ের বিবরণ পাশা পায়রা পরদার পোষাক। যাঁহার চারি প চারি খ, এই দুই পরিপূর্ণ হইবেক তিনি পুরা বাবু হইবেন। খ-য়ের বিবরণ খুসি খানকী খানা খয়রাত।… ফুলবাবু অর্থাৎ বাবু ফুল হইলেন। খলিপা সঙ্গে কখন বাগানে কখন নিজ ভবনে নানাজাতি প্রমোদিনী বিবিধ বিলাসিনী বারাঙ্গনা আনয়নপূর্ব্বক আপন মন খুসি করিতেছেন।’
দাদাবাদ আন্দোলন থেকে 'দাদা'
আবার বিশ শতকের শুরুর দিকের 'দাদা' বা 'দাদাবাদ' আন্দোলন শুরু হল। বাবু সংস্কৃতিতে ছিল বাবুয়ানার ধরন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আড্ডা, যা শিবনাথ শাস্ত্রী বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়, আর দাদা অথবা দাদাবাদ ছিল এক ধরনের বিদ্রোহী শিল্প আন্দোলন, যা আধুনিকতার প্রতীক ছিল।
মোদী, সৌগত ও 'বঙ্কিমদা'
হঠাত্ বাবু বা দাদা নিয়ে কেন চর্চা? ওই যে 'বঙ্কিমদা'। শুরু তো ওইখানেই। বন্দে মাতরম রচনার দেড়শো বছরপূর্তিতে সংসদে ভাষণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বারবার 'বঙ্কিমদা' বলে সম্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঠিক সেই সময় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলে উঠলেন, 'বঙ্কিমদা আবার কী? বাবু বলুন।' মোদী এরপরেই পাল্টা বললেন, 'ঠিক আছে, আমি বঙ্কিমবাবুই বলব। দাদা বলব না। আপনার অনুভূতিকে সম্মান করি। তাহলে আপনাকে দাদা ডাকতে পারি তো? না কি তাতেও আপত্তি রয়েছে?'
এরপরেই রাজনৈতিক তর্জা শুরু। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে, তখন কোচবিহারে সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বঙ্কিমদা ইস্যুতে খোঁচা দিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর মন্তব্য,'কাল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বললেন বঙ্কিমদা, যেন মনে হচ্ছে, হরিদা, শ্যামদা। জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন,তাঁকে এই টুকু সম্মান দিলেন না! আপনার নাকখত দেওয়া উচিত। বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিল, ৯০ শতাংশ শহিদ হয়েছিলেন বাঙালিই।'
কে দাদা, কে বাবু?
তবে রাজনীতির যে খেলা চলছে, তা তো দৃশ্যত। কিন্তু কাকে দাদা বলতে হবে, কাকে বাবু, তা নিয়ে তো আলোচনার অবকাশ থাকতেই পারে। বাংলা ভাষাবিদ ও অধ্যাপক পবিত্র সরকারের কথায়, 'যে সব মনীষীদের আমরা শ্রদ্ধা করি, তাঁদের সাধারণত আমরা দা বা দাদা বলি না। সেটা বঙ্কিমচন্দ্র হোন, বিদ্যাসাগর হোন, রবীন্দ্রনাথ হোন। আমরা তাঁদের শুধু নামও বলতে পারি। মণীষীদের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা একটু অসম্মানজনক। প্রত্যেক সংস্কৃতি আলাদা। দাদা, বাবা, এই ফারসি কথা। বিদেশি কথা। তাতে কিছু যায় আসে না। দাদা হলেন, একটু বয়সে বড়, একটু ঘনিষ্ঠ। শান্তিনিকিতনে শিক্ষকদের দাদা বলে অনেকে। মনীষীদের ক্ষেত্রে দাদা বলা অসম্মানজনক।'
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সঙ্গীতা সান্যাল বলছেন, 'দাদা কালচারটা বর্তমানে খুব বেশি দেখতে পাচ্ছি। উনিশ শতকে বাবু সংস্কৃতি এসেছিল বাংলায়। একটি স্বতন্ত্র কালচার গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আমরা যখন কোনও মনীষীকে সম্বোধন করি, দুটি কালচার কিন্তু একই নয়। বাংলার সেই বাবু কালচার বা সংস্কৃতির অন্ধকার দিক তুলে ধরার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে কলম ধরেছিলেন। প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সুতরাং, সেই বাবু আর বঙ্কিমবাবু বা শরত্বাবু এক নয়।'
তাঁর বক্তব্য, 'আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় বা সম্মানীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু দাদা ব্যবহার করি না। এটা একেবারে আমাদের কথ্য ভাষা। আমি দেখেছি কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপককে দাদা বলে সম্বোধন করা হয়, যা আমি পছন্দ করি না। দাদা সম্বোধনটা পাড়াতুতো, গ্রামতুতো। দেখুন মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের গুলিয়ে দিলে হবে না।'