ইজরায়েলের বিরুদ্ধে জোট বাঁধছে আরব ও ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি। সেই জোটে থাকছে পাকিস্তানও। দোহায় ৪০টি আরব ও ইসলামিক দেশগুলির এমার্জেন্সি বৈঠকে যা সিদ্ধান্ত হল, তাতে স্পষ্ট, ইউরোপ ও আমেরিকার NATO বাহিনীর স্টাইলে একটি বাহিনী তৈরি করার প্ল্যান করছে এই দেশগুলি একজোট হয়ে। কাতারের রাজধানীতে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। গাজায় হামাস জঙ্গিদের নিধনে যখন ইজরায়েল একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন NATO র মতো একটি মিলিটারি বাহিনী গড়ার ছক কষে ফেলল আরব ও ইসলামিক দেশগুলি। পাকিস্তানের দোসর তুরস্কও ছিল মিটিংয়ে। যার নির্যাস, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে বড়সড় পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব। যে বিশ্বে একদিকে থাকবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের NATO ও অন্যদিকে ইসলামিক দেশগুলির তৈরি NATO র মতো আরেকটি যৌথ মিলিটারি ফোর্স।
পাকিস্তানের মতলবটা কী?
মুসলিম দেশগুলির মধ্যে একমাত্র পরমাণু শক্তিধর হল পাকিস্তান। অন্যদিকে আবার তুরস্ক NATO র সদস্য দেশ হলেও, ভারত যখন অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানকে তছনছ করে দিচ্ছে, তখন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল তুরস্ক। ইসলামাবাদকে অস্ত্র ও সেনা জুগিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে আরব-ইসলামিক NATO স্টাইল মিলিটারি ফোর্স তৈরির প্ল্যান কিন্তু দিল্লির পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর হতে পারে।
দোহা সম্মেলনে নিজেদের মুসলিম উম্মাহর স্বঘোষিত রক্ষক হিসেবে তুলে ধরে পাকিস্তান কেন্দ্রবিন্দুতে। পাকিস্তান জোরদারভাবে একটি 'আরব–ইসলামিক টাস্ক ফোর্স' গঠনের পক্ষে সওয়াল করেছে। পাক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের কথায়, 'ইসলামিক দেশগুলিতে হামলা চালানো এবং গণহত্যা করার জন্য কোনওভাবেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয় ইজরায়েলকে।' পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ইসাক দারও একই ভাষায় সওয়াল করেন। সার্বিক ভাবে বলতে গেলে, জঙ্গি কার্যকলাপকে একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার ছক কষছে পাকিস্তান।
এখন মুসলিম দেশগুলি একজোট হয়ে NATO র মতো যৌথ মিলিটারি বাহিনী গড়লে ভারতের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে?
পাকিস্তানের এই প্রোঅ্যাকটিভ হওয়া কিন্তু তাত্পর্যপূর্ণ। কেবল কথার ফুলঝুরি নয়, এর পেছনে রয়েছে কৌশলগত হিসেব নিকেশও। আরব ইসলামিক ন্যাটোতে তাদের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ সরাসরি যুক্ত পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। যার মধ্যে আছে তথাকথিত 'স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ' নীতি, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যুকে উস্কে দেওয়র ছক। ভারতের কাছে তাই আরব–ইসলামিক ন্যাটো”-র মতো একটি জোটে ইসলামাবাদের সক্রিয় উপস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ইউনাইটেড টাস্ক ফোর্স গঠনে জোর দিচ্ছে পাকিস্তান
দোহার সম্মেলনে বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর মুসলিম দেশ পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি সরব হচ্ছে একটি যৌথ মিলিটারি টাস্ক ফোর্স গঠনের জন্য। এই টাস্ক ফোর্স যাতে দ্রুত তৈরি হয়, তার জন্য লবি তৈরি শুরু করেছে ইসলামাবাদ। প্রাথমিক উদ্দেশ্য হ, ইজরায়েলকে সবক শেখানো। ইশাক দারের দাবি, বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলমান এই সামিটের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা চায় একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ। শেহবাজ শরিফ ওদিকে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মহম্মদ বিন সলমনকে আশ্বাস দিয়েছেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সমর্থন থাকবে। পাকিস্তান ২০২৬ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে রয়েছে।
আবার আজব খেলা খেলছে তুরস্ক। এই দেশটি ইতিমধ্যেই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন NATO-র সদস্য। এখন ইজরায়েল বিরোধী আওয়াজে গলা মিলিয়ে ইজরায়েলের উপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছে। ইজরায়েলের লাগাতার আক্রমণকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোগান লোভী, রক্তপিপাসু ও সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ আখ্যা দিলেন।
ইসলামিক-আরব ন্যাটোতে পাকিস্তানের অতি সক্রিয়তা ও ভারত
ভারতের কাছে এর প্রভাব গভীর ও বহুমুখী হতে পারে। পাকিস্তান বরাবরই কাঁদুনি গেয়ে বহুপাক্ষিক জোট ও মঞ্চগুলিকে কাজে লাগায়। আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তারা আরব অর্থায়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নানা রকম নোংরা ছক কষতে থাকে। দোহা বৈঠকের টেবিলে আরেক সদস্য ছিল তুরস্ক। আঙ্কারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানের কাশ্মীরবিষয়ক অবস্থানকে জোরালো করছে। এ ক্ষেত্রে একটি পরমাণু শক্তিধর ইসলামিক সামরিক জোট তৈরি হলে দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। এর্দোগানের কাশ্মীর বিষয়ক অবস্থান নিয়ে ভারত আগেই তীব্র সমালোচনা করেছে।
ন্যাটোর মতো কোনও নিরাপত্তা চুক্তিতে, যেখানে এক সদস্যের ওপর আক্রমণ মানেই সব সদস্যের ওপর আক্রমণ ধরা হয় এবং সামরিক প্রতিক্রিয়া সমন্বিত হয়, সেই ধরনের জোট গড়ে উঠলে ভারতের অস্বস্তি বাড়াটা স্বাভাবিক, বিশেষত যখন পাকিস্তান ও তুরস্ক উভয়েই এর অংশ হয়।
যদি ন্যাটোর ধাঁচে এমন কোনও গোষ্ঠী গঠিত হয়, যেখানে এক সদস্যের ওপর আক্রমণ মানেই সব সদস্যের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে, তাহলে পাকিস্তান আরও সাহসী হয়ে উঠতে পারে। এতে ইসলামাবাদ নতুন এক বহুপাক্ষিক মঞ্চ পাবে ভারত বিরোধী কার্যকলাপ চালানোর জন্য। যার নির্যাস, জঙ্গিদের লালনপালন করা পাকিস্তান আরও বেশি করে জঙ্গি সংগঠনগুলিকে মদত দেবে।