পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বালুচিস্তান। যা সে দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৪৪%। এই অঞ্চলটি ইরান, আফগানিস্তান এবং আরব সাগর দিয়ে ঘেরা। এখানে থাকে বালুচ, পশতুন এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। বালুচ সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচয় রয়েছে। যা পাকিস্তানের থেকে একেবারে আলাদা, ঠিক যেমনটা বাংলাদেশের।
সম্পদের লুঠ
প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বালুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে বালুচরা কোণঠাসা। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পায় পঞ্জাবি সম্প্রদায়ের লোকেরা। তারাই এই সম্পদ ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই বালুচরা ক্ষুব্ধ। একসময় পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ থেকেও লুঠ করত পাকিস্তান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান নিজের প্রাপ্য পেত না। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ যেমন পাট এবং চা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির চাকা ঘোরাত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান কোনও সুবিধে পেত না।
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়কে অবজ্ঞা
পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়কেও স্বীকৃতি দেয়নি ইসলামাবাদ। বালুচিস্তানেও একই অবস্থা। পাকিস্তান সরকার বালুচ ভাষা ও সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দেয় না। বালুচ সম্প্রদায় মনে করে, তাদের পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সামরিক দমননীতি
১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে পাকিস্তান সেনা। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। বালুচিস্তানেও একই অবস্থা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বালুচ জাতীয়তাবাদীদের দমন করার জন্য বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান শুরু করে। বালুচিস্তান থেকে শত শত মানুষ নিখোঁজ। তাঁদের কোনও রেকর্ড নেই। এর পিছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে। বালুচিস্তানে বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য সীমাহীন। জাতীয় বাজেটের খুব সামান্য অংশ বরাদ্দ হয় এই প্রদেশের জন্য।
বালুচিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করতেন কলাতের নবাব। একইভাবে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। যার পরিণতি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম। বালুচিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করছে বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) এবং মাজিদ ব্রিগেডের মতো সংগঠনগুলি। ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলতে গেলে বাংলাদেশ সীমান্তের অধিকাংশ ঘেরা ভারত দিয়ে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাঙালি বিদ্রোহীদের সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা দিয়েছিল ভারত। বালুচিস্তান সীমান্তে রয়েছে ইরান ও আফগানিস্তান। বাংলাদেশের মতো বালুচিস্তানেরও সমুদ্রসীমা রয়েছে। যা যুদ্ধের রণনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
বালুচিস্তানের ৫ থেকে ৭টি জেলা ভাঙতে পারে
বালুচিস্তানে বিদ্রোহের পরিস্থিতি দেখে পাকিস্তানি সাংসাদ মাওলানা ফজলুর রহমান প্রায় তিন সপ্তাহ আগে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বালুচিস্তানের পাঁচ থেকে সাতটি জেলা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে একই রকম পরিস্থিতি আবারও তৈরি হতে পারে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে (এনএ) তিনি আশঙ্কা করেছেন, বালুচিস্তানের জেলাগুলি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে স্বীকৃতি দিতে পারে রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
কোয়েটায় ইন্দিরার জয়ধ্বনি
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অনিল অঠালে একটি প্রবন্ধে দাবি করেছেন,১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ চলার সময় বালুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে কোয়েটায় মিছিল বের হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী এবং আশ্চর্যজনকভাবে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। সাতের দশকে প্রথম বালুচ বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করে জেনারেল টিক্কা খান। 'বালুচিস্তানের কসাই' নামে খ্যাত এই পাক সেনাপ্রধান।
দেশভাগের সময় থেকেই স্ফুলিঙ্গ
বালুচিস্তানে বর্তমানে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জ্বলছে, তার শিকড় রয়েছে দেশভাগের সময় থেকেই। তখন বালুচিস্তান চারটি অঞ্চল (কালাত, খারান, লস বুলা, মাকরান) নিয়ে গঠিত ছিল। এটি এমন একটি অঞ্চল ছিল যা সরাসরি ব্রিটিশদের শাসনে ছিল না।
ভারতের স্বাধীনতার পর বালুচ উপজাতিদের সর্দারদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তুঙ্গে ছিল। তারা নিজেদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র চেয়েছিল। পাকিস্তানের জন্মের একদিন পর কালাত নিজেদের একটি স্বাধীন জাতি ঘোষণা করে। কালাত-এর নবাব মীর আহমেদ ইয়ার খান কালাত সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষ তৈরি করেছিলেন। কালাত ঘোষণা করেছিল, তারা স্বাধীন জাতি। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল কালাতে সেনা পাঠান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে কালাতের বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তির দলিল স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। সাড়ে আট মাস ধরে চলা স্বাধীন কালাত সরকার ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগুন বালুচিস্তানদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকে।
আকবর খান বুগতি এবং মোশাররফের ভুল
নবাব আকবর খান বুগতি বালুচিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসে এক বড় মুখ। ৬ ফুট লম্বা, মোটা গোঁফ, কর্তৃত্বপরায়ণ এবং রুক্ষ স্বভাবের আকবর খান ছিলেন বুগতি বংশের প্রধান নবাব মেহরাব খান বুগতির পুত্র। ২০০৫ সালে বুগতি পাকিস্তান সরকারের কাছে ১৫-দফা দাবি পেশ করেন। তাদের দাবি ছিল, বালুচিস্তানের জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া উচিত। সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হোক। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক পারভেজ মোশাররফ তাঁর কথায় কান দেননি। সেই সময় বালুচিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর ক্রমাগত আক্রমণ চলছে।
ঠিক যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ভুল করেছিল, মোশাররফ বালুচিস্তানেও একই ভুল করতে শুরু করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আকবর বুগতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেন তিনি। বুগতিকে খতম করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর বাড়িতে বিমান হামলা চালায়। বুগতি আত্মগোপনে চলে যান।
বালুচিস্তান থেকে প্রায় ১.৫ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে নবাব আকবর খান বুগতি শেষ পর্যন্ত নিহত হন। তারিখটা ছিল ২০০৫ সালের ২৬ অগাস্ট। এই সামরিক পদক্ষেপকে বালুচ সম্প্রদায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখেছে। এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান হিসেবে দেখায় পাকিস্তান সরকার। বলা হয় যে বুগতি একটি গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার এবং ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। গুহা ধসে পড়লে তিনি মারা যান। আকবর বুগতির হত্যাকাণ্ড বালুচ আন্দোলনকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যায়। তা আরও সহিংস হয়ে ওঠে। বুগতির হত্যার পর বিএলএ মাজিদ ব্রিগেড নামে একটি আত্মঘাতী দল গঠন করে। তারা হাই-প্রোফাইল হামলার জন্য দায়ী। বুগতির ছেলে জামিল বুগতি জানান,তার বাবার মৃত্যু বালুচ নারীদের আন্দোলনে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। নারীরা এখন বালুচ আন্দোলনের নতুন কণ্ঠস্বর এবং মুখ।
বুগতির হত্যাকাণ্ড বালুচ আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় নিয়ে আসে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করে।