পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ দুই প্লেয়ার, ইরান ও ইজরায়েল— গত কয়েক দশক ধরে তীব্র সংঘাতের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। এই সংঘাত শুধু রাজনৈতিক নয়, এর পেছনে রয়েছে ধর্মীয়, সামরিক এবং কূটনৈতিক নানা কারণ। অনেকটা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের মতো, তবে তার থেকেও জটিল ও বিপজ্জনক।
সংঘাতের শুরু: এক সময়ের মিত্র, এখন চরম শত্রু
১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরে ইরানই ছিল প্রথম মুসলিম দেশগুলির মধ্যে একটি যারা তাকে স্বীকৃতি দেয়। তৎকালীন ইরান রাজতন্ত্র ছিল পশ্চিম ঘেঁষা এবং আমেরিকার ঘনিষ্ঠ। তাই ইজরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্কও ছিল উষ্ণ। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লব সবকিছু বদলে দেয়। ইরানে রাজতন্ত্র উৎখাত করে আয়াতোল্লাহ খামেনেই নেতৃত্বাধীন শিয়া ইসলামিক সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন থেকেই ইজরায়েলকে ‘শয়তানের রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করে ইরান। নতুন শাসকেরা মনে করে, প্যালেস্তাইনের উপর দমননীতি চালিয়ে ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করতে চায়। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ শত্রুতার দিকে যায়।
মূল সংঘাত: প্যালেস্তাইন, হিজবুল্লাহ, পরমাণু ও আধিপত্য
ইরান-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব মূলত চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে—
১. প্যালেস্তাইন ঘিরে সংঘাত
ইরান নিজেকে ফিলিস্তিনের ‘পক্ষের শক্তি’ বলে দাবি করে এবং ইজরায়েলের অস্তিত্বই অস্বীকার করে। প্যালেস্তাইনের হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো সংগঠনের পেছনে ইরান রয়েছে, যারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা চালায়। এই কারণে ইজরায়েল ইরানকে তার অস্তিত্বের হুমকি মনে করে।
২. পরমাণু কর্মসূচি
ইরান যে গোপনে পরমাণু বোমা তৈরি করছে, এমন সন্দেহে ইজরায়েল বরাবরই উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে, ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র গেলে ইজরায়েলের নিরাপত্তা ভয়ংকরভাবে বিপন্ন হবে। তাই ইজরায়েল একাধিকবার ইরানের পরমাণু গবেষণাগারে সাইবার হামলা চালিয়েছে, এমনকি পরমাণু বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
৩. সিরিয়া ও লেবানন ফ্যাক্টর
ইরান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থক এবং সেখানে সেনা পাঠিয়েছে। সেইসঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহ সংগঠনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। হিজবুল্লাহ প্রায়ই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। এইভাবে ইরান ‘ইজরায়েল ঘিরে রাখার’ কৌশল নিচ্ছে বলে অভিযোগ।
৪. মধ্যপ্রাচ্যের আধিপত্যের লড়াই
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, ইজরায়েল, আমেরিকা ও অন্য সুন্নি দেশগুলির সঙ্গে ইরান (একটি শিয়া দেশ) রাজনৈতিক-সামরিক আধিপত্যের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষমতার টানাপোড়েনেও ইরান-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি: যুদ্ধ কি আসন্ন?
২০২৩–২৪ সালে গাজায় হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে আসে। ইজরায়েলের দাবি, হামাসের এই হামলার পিছনে ইরানের হাত রয়েছে। পাল্টা হিসাবে ইজরায়েল সিরিয়া ও ইরাকের ভিতরে ইরান ঘনিষ্ঠ ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়। ২০২৪ সালের শেষে ইজরায়েলের দামাস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর পাল্টা জবাবে ২০২৫ সালে ইরান সরাসরি ইজরায়েলের ভূখণ্ডে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়—এই প্রথমবার। যদিও অধিকাংশ হামলা ইজরায়েল থামিয়ে দেয়, কিন্তু এটি মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি যুদ্ধের নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।