ধরুন আপনি কোনও দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ এক লাফে দেওয়াল ভেদ করে ওপারে পৌঁছে গেলেন। দেয়াল না ভেঙেই এপার ওপার! শুনতে কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো লাগছে? কিন্তু বিজ্ঞানের দুনিয়ায় বাস্তবেই এমনটা ঘটে, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে! এই আশ্চর্য ঘটনাকেই বলে 'কোয়ান্টাম টানেলিং'। আর এই 'জাদু' নিয়ে কাজ করেই ২০২৫ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন তিন বিজ্ঞানী, জন ক্লার্ক, মিশেল ডেভোরে ও জন মার্টিনিস।
এই তিন বিজ্ঞানী 'বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের প্রমাণ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন'। কথাটা একটু কঠিন শোনালেও, আসলে বেশ মজার। কোয়ান্টাম আসলে এমন এক জগৎ, যেখানকার কোনও জিনিস খালি চোখে দেখা যায় না, যেমন, ইলেকট্রন, প্রোটন বা ছোট ছোট পরমাণু। ছোটবেলায় পড়েছেন নিশ্চই?
মজার বিষয়টি হল, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলির আচরণও অদ্ভুত। কখনও এগুলি তরঙ্গের মতো, কখনও বা কণার মতো মুভ করে।
বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, এই কোয়ান্টাম জগতের আচরণ কি মানুষের খালি চোখেও দেখা সম্ভব? মানে, এমন কোনও যন্ত্র কি তৈরি করা যায়, যেখানে কোয়ান্টাম জগতের পরমাণু, ইলেকট্রন, প্রোটনের কার্যকলাপ খালি চোখে দেখা যাবে?
১৯৮০ র দশকে এই তিন বিজ্ঞানী সেই রহস্যেরই উত্তর খুঁজতে নামেন। তাঁরা এমন এক ক্ষুদে সার্কিট বানান, যার দুই পাশে তার আছে। আর তার মাঝখানে একটি বিন্দুর মতো ক্ষুদ্র ইনসুলেটর। এই ইনসুলেটরটি আসলে দুইটি তারের মাঝে একটি দেওয়ালের কাজ করছে। এই ছোট অংশটির নাম Josephson Junction।
এবার ওঁরা সেই সার্কিটে বিদ্যুৎ চালালেন। যা ঘটল, তা সত্যি অবিশ্বাস্য! বিদ্যুৎ মাঝের সেই দেওয়ালের সামনে এসেও থামল না, সোজা দেওয়াল ভেদ করে অন্য দিকের তার দিয়ে বেরিয়ে গেল! ঠিক যেন দেওয়ালের এক পাশ থেকে অন্য পাশে টেলিপোর্ট করল। এই ঘটনাকেই বলে 'Quantum Tunnelling'।
আরও মজার ব্যাপার হল, এই সার্কিট একটানা পাওয়ার টানে না। বরং ভাগে ভাগে টানে, আবার ছাড়েও ভাগে ভাগে। যেন কেউ বাঁ হাতে একটি লাড্ডু তুলে নিচ্ছে, তারপর একটা দেওয়াল ভেদ করে ছুঁড়ে ডান হাতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটাকেই বলে Energy Quantisation।
তিন বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কারে একেবারে বদলে গেল বিজ্ঞানের ইতিহাস। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, কোয়ান্টামের জগত শুধু ক্ষুদ্র কণাতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের হাতে ধরা যন্ত্রেও তা চাক্ষুষ করা সম্ভব।
এই গবেষণার উপর বেস করেই এখন ভবিষ্যতের ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার’ তৈরি করা হচ্ছে।
নোবেল কমিটির প্রধান ওলে এরিকসন বলেন, 'শতাব্দী প্রাচীন কোয়ান্টাম থিওরি আজও আমাদের নিত্যনতুন বিস্ময় উপহার দিচ্ছে।' আর নোবেলজয়ী জন ক্লার্কের কথায়, 'এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ!'
তিন বিজ্ঞানী যেন এটাই প্রমাণ করলেন যে, দেয়াল, বাধা, সীমা, সবই মানুষের কল্পনা। প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের জগতে সবই সম্ভব।