প্রথমে পাকিস্তানের আদালত অসামরিক নাগরিকদের সেনা আদালতে বিচার বন্ধের নির্দেশ দিলেও এবার সেনা ও প্রশাসনের আপিলে সেই রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। এবার পাকিস্তান আর্মি অ্যাক্টের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা পুনরায় কার্যকর হয়েছে। ফলে ৯ মে-র ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সেনা আদালতে বিচার করার রাস্তা পুরোপুরি খুলে গেল। পিটিআই এই রায়ের কড়া সমালোচনা করেছে। দলের নেতা ওমর আইউব খান এটিকে ‘অস্ত্রোপচারের রায়’ আখ্যা দিয়ে বলেন, 'যে দিন সরকার ও সেনা একসাথে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে, সেদিনই এই রায় দিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বর বন্ধের নতুন ফন্দি করা হচ্ছে।' পিটিআই-র সিন্ধু প্রদেশের প্রধান হালিম আদিল শেখ বলেন, 'ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের আবহে এই রায় দেওয়া হয়েছে যাতে অন্যায় ঢাকতে সুবিধা হয়।'
এই রায় কার্যত গণতন্ত্রকে আরও কোণঠাসা করবে
এদিকে আন্তর্জাতিক মহলেও পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকেই বলছেন, পাকিস্তানে এমনিতেই সেনাবাহিনী সব সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্ধকারে থেকেছে। এবার সুপ্রিম কোর্টের এই রায় কার্যত গণতন্ত্রকে আরও কোণঠাসা করবে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যখন আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে, ঠিক তখনই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দিল ইসলামাবাদের শীর্ষ আদালত। ৭ মে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বেসামরিক নাগরিকদের সেনা আদালতে বিচার করার অনুমতি দিল। এটি শুধু পাকিস্তানের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলানোর ইঙ্গিতই নয়, বরং ভারতের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রায় জেনারেল মুনিরের জন্য 'টাইমলি স্ট্র্যাটেজিক পুশ' হিসেবে কাজ করবে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় তাঁর দখল শিথিল হতে শুরু করেছিল। এই রায়ের পর তিনি দেশের ভিতরের বিরোধী গোষ্ঠী ও বিক্ষোভকে কঠোর হাতে দমন করতে পারবেন।
২২ এপ্রিলের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার ছায়া
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে ২২ এপ্রিলের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার ছায়া। ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে এই হামলায় উত্তেজনা চরমে ওঠে। পাকিস্তান তখন থেকেই চাপে ছিল। জেনারেল মুনির হামলার ঠিক আগে তাঁর বক্তব্যে 'দুই-জাতি তত্ত্ব'-এর উল্লেখ করে বলেন, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য কখনও মিটবে না। তিনি কাশ্মীরকে পাকিস্তানের 'লাইফ লাইন' বা 'জাগুলার ভেইন' বলেও দাবি করেন।
এর পরেই মুনিরের হুমকি, যদি ভারত 'মিলিটারি অ্যাডভেঞ্চার' করে, তাহলে তার 'দ্রুত ও কঠোর' জবাব দেওয়া হবে। তাঁর এই কথাবার্তায় বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, মুনির ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিকে সক্রিয় করতে চাইছেন, কারণ দেশের ভিতরে তাঁর জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। ইমরান খানের দল পিটিআই-এর বিক্ষোভে যখন সেনা শিবির ও স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছিল ২০২৩ সালের ৯ মে, তখন থেকেই মুনির কঠোর অবস্থান নেন। প্রায় ১,০০০ জন পিটিআই সমর্থককে ধরা হয়েছিল। তখনই সেনা আদালতে তাদের বিচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও প্রথমে আদালত সেটিকে অসাংবিধানিক বলেছিল, এবার ফের তা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সেনার হাতই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী
পিটিআই এই রায়ের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এই রায় জেনারেল মুনিরকে আরও একতরফাভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ করে দেবে। দলের নেতা ওমর আইউব বলেন, 'এই রায় আসলে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করার এক নতুন হাতিয়ার।' সিন্ধুর নেতা হালিম আদিল শেখ বলেন, 'যখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তখন এই রায় দিয়ে সেনা সরকার অন্যায় ঢাকার চেষ্টা করছে।'
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান আবার প্রমাণ করল যে সেদেশে সেনার হাতই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। গণতন্ত্র সেখানে কতটা অসহায়, এই রায়ে তা আরও একবার স্পষ্ট হল। ভারতের অপারেশন সিঁদুর নিয়ে যখন পাকিস্তান চাপে রয়েছে, তখন দেশের ভিতরে এমন রায় আসা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্লেষকদের মতে, আসিম মুনির নিজের অবস্থান আরও মজবুত করার জন্য এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন। পাকিস্তান আবারও প্রমাণ করল যে সেদেশে সেনা মানেই চূড়ান্ত ক্ষমতা। গণতন্ত্র সেখানে বরাবরই ছিল মুখোশ।