
রাশিয়া-ইউক্রেন, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের মধ্যেই নতুন করে আরও দুই দেশের লড়াই শুরু হয়েছে। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধ। মার্কিন প্রেসিডেন্ড ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় মাত্র ৬ সপ্তাহ আগেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তি ভুলে আবার আক্রমণ শুরু হয়েছে। দুই দেশের সরকারই একে অপরকে দোষারোপ করছে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের জুলাই মাসে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল,তা আবার মাথাচাড়া দিল। ৩ লক্ষের বেশি মানুষ ঘরছাড়া। ৪৮ জনের বেশি নিহত সরকারি হিসেবে।
কেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া যুদ্ধ করছে?
এই দুই দেশের ঝগড়া নতুন নয়। এই সংঘর্ষের আসল শুরু ১৯০৭ সালে। বস্তুত, দুই দেশই একদা ফরাসি উপনিবেশ ছিল। এক ফরাসি ঔপনিবেশিক মানচিত্রকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা থেকেই মূলত ঝগড়ার সূত্রপাত। সেই মানচিত্রে ৫০৮ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে প্রেহ ভিহেয়ার ও তা মুয়েন থমের মতো খেমার যুগের বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্দির এলাকা রয়েছে। এই অস্পষ্টতার জেরেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ১৯৬২ সালে রায় দেয়, প্রেহ ভিহেয়ার মন্দির কম্বোডিয়ার অধীনে। কিন্তু থাইল্যান্ড মন্দিরের সংলগ্ন ভূমি নিয়ে আপত্তি চালিয়ে যায়।
২০০৮ সালে হঠাত্ কম্বোডিয়া খেমার যুগের ওই মন্দির এলাকাকে UNESCO হেরিটেজ স্টেটাসের জন্য চেষ্টা শুরু করে। ব্যস, তাতেই আগুনে ঘি! থাইল্যান্ড রেগে যায়। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। সেই সময় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলেন। ২০১১ সালে ফের আন্তর্জাতিক আদালত কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু বিতর্কিত জমি ঘিরে কোনও সমাধান মেলেনি। ফলে আগুনটা জ্বলেই রইল। ব্যাংককে বসবাসকারী এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিল রবার্টসনের কথায়, 'ওই মন্দির এলাকার এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি নয় দুই দেশই।'
জুলাই মাসে কী হয়েছিল ও কেন?
২০০৮ সালের পর থেকে মোটামুটি শান্তিই ছিল। হঠাত্ লড়াই মাথাচাড়া দিল ২০২৪ সালে মে মাসে। স্কিরমিশে সীমান্তে এক কম্বোডিয়ান সেনার মৃত্যুর পরেই থাইল্যান্ডকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে কম্বোডিয়া। দুই দেশই আরও সেনা মোতায়েন শুরু করে দেয়সীমান্তে। জুলাইয়ের শুরুতে বিতর্কিত এলাকায় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে ৩ জন থাইল্যান্ড সেনা গুরুতর জখম হলেন। থাইল্যান্ড দাবি করল, রাশিয়ার অত্যাধুনিক ল্যান্ডমাইন ব্যবহার করছে কম্বোডিয়া। যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দেয় কম্বোডিয়ার সরকার। কিছু দিন পরেই আরও একটি বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হলেন আরও ৫ জন থাই সেনা।
জবাবে থাইল্যান্ড উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত চেকপোস্ট বন্ধ করে দেয়। কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে এবং নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতকেও ফনম পেন থেকে ডেকে পাঠায়। প্রতিশোধ হিসেবে কম্বোডিয়া থাই রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে। কম্বোডিয়া সব থাই মিডিয়া নিষিদ্ধ করে, থাই পণ্যের আমদানি সীমিত করে এবং কিছু সীমান্তবর্তী ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে হাজার বছরের প্রাচীন প্রসাত তা মুয়েন থম মন্দিরের কাছে ৫ দিন ধরে টানা সংঘর্ষ শুরু হল। যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ ঘরছাড়া হলেন। হাজার হাজার কম্বোডিয়ান পরিযায়ী শ্রমিক পালিয়ে যান। ব্যাংককের রাস্তায় থাইল্যান্ডের পতাকার সংখ্যা হঠাৎই বেড়ে যায়, আর কম্বোডিয়ার সরকারি মহল অতীতের নানা বঞ্চনার কথা তুলে ধরে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে।
যুদ্ধবিরতিতে কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জড়িয়ে পড়লেন?
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধবিরতি করাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতিয়ার হল সেই ট্যারিফ। হুঁশিয়ারি দিলেন, যুদ্ধ না থামলে মোটা অঙ্কের ট্যারিফ চাপাবেন। চিনের তরফেও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ দেখা যায়। অক্টোবরের শেষ দিকে মালয়েশিয়ায় আসিয়ান সম্মেলনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি মূল সমস্যার সুরাহা নিয়ে হয়নি। কারণ মূল জট ছড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিক আমলের মানচিত্রকে ঘিরে সীমান্ত-নির্ধারণের পুরনো বিরোধে, যা এখনও মেটেনি।