Advertisement

বোনের বিয়েতে আলাপ, চার দশক পর ইন্ডাস্ট্রির ভাবনা ভুলে এবার দাদার কাছে 'অপু'

স্ত্রী, ঝিন্দের বন্দি,দেবদাস সহ ৯টি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল দুই তারকাকে। তবে দু'জনের আলাপ কিন্তু তার আগেই। একবার নিজেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গল্প করেছিলেন, বোনের বিয়েতে প্রথম মহানায়কের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জামাইবাবু ছিলেন উত্তম কুমারের বন্ধু। এরপর ১৯৬১ সালে তপন সিনহার ঝিন্দের বন্দিতে প্রথমবার একসঙ্গে কাজ করেছিলেন বাংলা সিনেমার দুই মহীরূহ। সেই সময় আউটডোরে শ্যুটিং করতে গিয়ে দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেকটাই গাঢ় হয়েছিল।

 Uttam Kumar & Soumitra Chatterjee Uttam Kumar & Soumitra Chatterjee
সুমনা সরকার
  • কলকাতা,
  • 15 Nov 2020,
  • अपडेटेड 9:07 PM IST
  • শোনা যায় ব্যক্তিগত জীবনে উত্তম ও সৌমিত্রের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ভাল
  • সুচারু ভাবে পেশাগত জীবনের রেষারেষি কখনও সামনে আসতে দেননি
  • এমনকি দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলেও সৌমিত্রকে জড়িয়ে ধরেছিলেন মহানায়ক

বাংলা সিনেমার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বলতে যা বোঝায় সিনে প্রেমীদের কাছে তাই যেন ছিলেন উত্তম কুমার আর সৌমিত্র  চট্টোপাধ্যায়। ছয় ও সাতের দশকে চায়ের কাপে তর্ক ও ঝগড়ায় ঝড় উঠত দুই তারকার অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে। কিন্তু দুই অভিনেতার মধ্যে পেশাগত যতই রেষারেষি থাকুক না কেন শোনা যায় ব্যক্তিগত জীবনে কিন্তু দুজনের সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল।

ব্যক্তিগত জীবনে উত্তম ও সৌমিত্রের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ভাল

স্ত্রী, ঝিন্দের বন্দি,দেবদাস সহ ৯টি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল দুই তারকাকে। তবে দু'জনের আলাপ কিন্তু তার আগেই। একবার নিজেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গল্প করেছিলেন, বোনের বিয়েতে প্রথম মহানায়কের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জামাইবাবু ছিলেন উত্তম কুমারের বন্ধু। এরপর ১৯৬১ সালে তপন সিনহার ঝিন্দের বন্দিতে প্রথমবার একসঙ্গে কাজ করেছিলেন বাংলা সিনেমার দুই মহীরূহ। সেই সময় আউটডোরে শ্যুটিং করতে গিয়ে দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেকটাই গাঢ় হয়েছিল। যদিও বয়সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকে বড় ছিলেন উত্তম কুমার। উত্তমের জন্ম ১৯২৬ সালে কলকাতা শহরে। অন্যদিকে সৌমিত্রর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি। বাংলা সিনেমায় ঘটি উত্তম না ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার বাঙাল সৌমিত্র কে বেশি মেয়েদের মনে ঝড় তুলিছেলেন তা নিয়ে একটা সময় বহু নিউজ প্রিন্ট খরচা করেছে মিডিয়া হাউসগুলি। উত্তমকুমার যদি হন ম্যাটিনি আইডল, তবে  সৌমিত্র ঘরের ছেলে ৷ উত্তম যদি হন সত্যজিতের ‘নায়ক,সৌমিত্র হলেন ‘অপু’, ‘ফেলুদা’ ! ইমেজ তৈরিতে মহানায়ক থেকে কোনও অংশেই কম যান নি সৌমিত্র ৷ তা অকপটে স্বীকার করতেন অনেক উত্তম প্রেমি মানুষেরাই ৷ কারণ, সৌমিত্র ঠিক যেন ‘নেক্সট ডোর গাই’!

১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল‘সাড়ে চুয়াত্তর’। সেই থেকে শুরু হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রে  উত্তম যুগ। যার সমাপ্তি ঘটে ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে অকালে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার মহানায়ক। বাংলা স্বর্ণযুগের সিনেমার সেরা আবিষ্কার বলতেই হবে ‘মহানায়ক’কে। অপলক আকর্ষণীয় চাহনি৷ ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসি৷ দুর্দান্ত অভিনয়… এটুকুই যথেষ্ট উত্তম কুমার আবেগটাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। কত মোহমোয়ী তাঁর মোহে মুগ্ধ হয়ে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন এককালে। 

Advertisement

আরও পড়ুন

তবে এটাও মানতে হবে চরম উত্তম যুগেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মনজয় করা ছবির তালিকা শুরু হলে , তা শেষ করা ছিল দুষ্কর। পঞ্চাশের দশকে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন কেড়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এতো বছর পরেও অভিনেতা হিসেবে এতোটুকু ম্লান হননি।নায়ক হিসাবে শুধু সুপুরষই নন, তাঁর কণ্ঠস্বরে মজে থাকেনি এমন মহিলার সংখ্যা মেলা ভার ! চোখের গভীরতায় , তাঁর ভুরু কোঁচকানো চাউনিতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত  তিনি যেকোনও বাঙালি মহিলার দৃষ্টি স্থির করে দিতে পারতেন। ছিপছিপে লম্বা চেহারা আর মুখে শিশুর সারল্য , এই 'আইকনিক' বৈশিষ্ট্য নিয়েই পথ চলা শুরু করেছিলেন সত্যজিতের 'অপু'। যা থেমে গেল উত্তম কুমারের প্রয়ানের ঠিক ৪০ বছর পর। 

উত্তমকুমার টলিউডের মহানায়ক। আর সত্যজিৎ রায় সর্বকালের সেরা পরিচালক। এই দুই কিংবদন্তী এক সঙ্গে কাজ করেছিলেন মাত্র এক বার। 'নায়ক' ছবিতে সত্যজিৎ রায় উত্তমকুমারকে নিয়েছিলেন। এরপর সত্যজিৎ রায়ের আরেকটি ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় করার সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা বাস্তবে হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪টিতে অভিনয় করেছিলেন।  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের টলিউডের মহীরুহ হয়ে ওঠার পথ চলার শুরুটাই হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে। যাকে বলে অপুর সংসার থেকে ফেলুদা হয়ে ওঠা।মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের প্রথম পছন্দ ছিলেন সৌমিত্রই।

সত্যজিতের সঙ্গে ২ নক্ষত্র

অভিনয় জগতে রেষারেষি অবশ্য নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফেলতে দেননি উত্তম ও সৌমিত্র কেউই। তবুও একটা সময় দুই অভিনেতার মধ্যেই তৈরী হয়েছিল দূরত্ব। আর তার পেছনে ছিল শিল্পী সংসদের আত্মপ্রকাশ। তবে সেই দূরত্ব সত্ত্বেও বসুশ্রী সিনেমাহলের এক অনুষ্ঠানে দুই মেরুতে থাকা উত্তম ও সৌমিত্রের মধ্যে বরফ গলেছিল। পায়ে হাত দিয়ে উত্তমকে প্রণাম করায় সৌমিত্রকে জড়িয়ে ধরেছিলেন মহানায়ক। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিজের দাদার মতই উত্তমকে দেখে গিয়েছেন সৌমিত্র। 

পেশাগত জীবনের রেষারেষি কখনও সামনে আসতে দেননি কেউ

উত্তম কুমারকে বুড়ো হতে হয়নি। কিন্তু উত্তম পরবর্তী সময়ে এই ইন্ডাস্ট্রিকে ৪০ বছর ধরে সামলেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নায়ক থেকে চরিত্র অভিনেতা, এমনকি সত্যজিতের ফেলুদাকে দাদুর চরিত্রেও অভিনয় করতে দেখেছে বাঙালি দর্শক। একসময় নিজেই স্মৃতিচারণায় সৌমিত্র বলেছিলেন, সময়টা সত্তরের দশকের শেষলগ্ন, খ্যাতির মধ্যগগনে তখন উত্তমকুমার। একদিন কথাপ্রসঙ্গে সৌমিত্রকে উত্তম বলেছিলেন, 'দূর আর ভালো লাগছে না!' সেই সময় সৌমিত্র উত্তমকুমারকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ' বুড়োর রোলগুলো করতে হবে না? কোত্থেকে হবে, এখন থেকে ভালো না লাগলে? আপিন আর আমি বুড়ো না হলে ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো বুড়ো পাওয়া যাবে না!' শুনে হাসতে শুরু করেছিলেন মহানায়ক। আর কী আশ্চর্য! উত্তমের আর বুড়ো হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু বুড়ো হয়েও ৮৫ বছর বয়সেও একচুলও তফাতে যান নি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আদবকায়দায়। জীবেনর শেষ দিনগুলিতেও ছিলেন সমান অকপট।  রুপোলি পর্দায় এখনও তাঁর  আগমণ ঘটলে, একাই কেড়ে নিতেন গোটা ফ্রেম ৷ তা ‘বেলাশেষে’ হোক কিংবা ‘পিস হাভেন’, কিংবা ‘প্রাক্তন’-এর ট্রেনের কামরার দাম্পত্য ৷ সিনেমার পাশাপাশি নাট্যমঞ্চ, আবৃত্তি, শ্রুতি নাটক সব কিছুতেই তিনি ছিলেন ‘তিন ভুবনের পারে’র সেই স্মার্ট যুবক ৷ টাইট ট্রাউজারে, টুইস্ট নাচে, যেন সেই জনপ্রিয় গানের লাইন ‘জীবনে কী পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা...’ সত্যিই আজ ভাবনা ভুলে জীবনের ওপারে বড় দাদার কাছে চলে গেলেন সৌমিত্র ৷ সেখানে হয়তো এবার সত্যজিৎ রায় এই দুই কালজয়ী অভিনেতাকে নিয়ে লিখছেন তাঁর নতুন ছবির স্ক্রিপ্ট। 

 

Advertisement
Read more!
Advertisement
Advertisement