অসমে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিতকরণ ও দেশছাড়া করার ক্ষেত্রে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের (FT) জটিলতা এড়িয়ে এবার সরাসরি প্রশাসনিক পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি স্পষ্ট জানান, ১৯৫০ সালের Immigrants (Expulsion from Assam) নির্দেশ অনুযায়ী জেলা প্রশাসন এখন থেকে নিজেই বিদেশিদের বিতাড়িত করতে পারবে। অর্থাৎ, কোর্টে মামলা ঝুলে থাকলেই কেবল রেহাই, নয়তো সরাসরি ‘পুশব্যাক’।
কেন হঠাৎ ৭৪ বছরের পুরনো আইন?
হিমন্তর দাবি, সুপ্রিম কোর্ট 6A ক্লজ মামলার শুনানিতে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে ১৯৫০ সালের অর্ডার এখনও বলবৎ। এতদিন আইনজীবীরা এই বিষয়টি তুলে ধরেননি বলেই, সরকার জানত না। কিন্তু বাস্তব বলছে, NRC জটিলতায় কেন্দ্র ও রাজ্য দুইই ব্যাকফুটে, আর সেই জায়গায় পুরনো আইন তুলে এনে দ্রুত পদক্ষেপ দেখাতে চাইছে বিজেপি সরকার।
বাংলাদেশ কি এবার সরাসরি নিশানায়?
অসমে বিদেশি বলতে মূলত যাঁদের বোঝানো হয়, তাঁদের বৃহৎ অংশকে ‘বাংলাদেশি মুসলমান’ বলেই প্রচারে তুলে ধরে বিজেপি। NRC প্রকাশের সময় থেকেই এই প্রচার চলেছে। হিমন্ত নিজেও একাধিকবার বলেছেন, 'অসমে অনুপ্রবেশ করে জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে দেওয়া হচ্ছে।' ১৯৭১ সালের আগে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব সংরক্ষিত। কিন্তু বিজেপির রাজনৈতিক বক্তব্য অনুযায়ী, তারপরও প্রচুর বাংলাদেশি মুসলমান আসামে ঢুকেছেন। NRC-তে নাম বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষের মধ্যে বড় অংশ ছিল মুসলমান—এই নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। তাই ১৯৫০ সালের আইন তুলে এনে প্রশাসনের হাতে সরাসরি ‘ডিপোর্ট’ করার ক্ষমতা তুলে দিলে, কার্যত টার্গেট হবে সেই তথাকথিত 'অবৈধ বাংলাদেশিরাই'—বিশেষত যাঁরা আদালতের আওতায় এখনও আসেননি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি কী বলছে?
এই সিদ্ধান্ত ঘিরে মানবাধিকার কর্মীদের কড়া আপত্তি। অভিযোগ, একজন নাগরিককে ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া, তাকে দেশে ফেরত পাঠানো—এ এক গভীর আইনি সিদ্ধান্ত। আদালতের পর্যালোচনা ছাড়া প্রশাসনের হাতে এই ক্ষমতা থাকা সংবিধানবিরোধী। আর এই ক্ষমতা প্রয়োগে জাতিগত ও ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা প্রবল। বিশেষত, ১৯৫০ সালের অর্ডার বলবৎ হলেও তা ছিল দেশভাগ পরবর্তী বাস্তবতায়। এখন যেভাবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আদতে 'আধুনিক বাংলাদেশি মুসলমান' ইস্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করারই চেষ্টা, এমনটাই বলছে বিশ্লেষকরা।
NRC ব্যর্থ, তাই বিকল্প পথ?
২০১৯ সালে NRC প্রকাশিত হলেও সরকার নিজেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শোনা যায়, বহু হিন্দু অভিবাসীর নামও বাদ পড়ে যায়, যা BJP-র পক্ষে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই NRC আপাতত স্থগিত। আর FT-এর মাধ্যমে বিচারের গতি এত ধীর যে, কার্যত বহু মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। তাই মুখ্যমন্ত্রী এখন সরাসরি প্রশাসনিক আদেশে কাজ সারতে চাইছেন।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বাংলাদেশ?
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়তে পারে। যদিও সরকার স্পষ্ট করেনি যে ‘পুশব্যাক’ হলে তা ভারতের সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, কিন্তু তা পরোক্ষে বোঝানো হচ্ছে। আর এটাই ঢাকার পক্ষে উদ্বেগের। কারণ, অতীতে NRC ইস্যুতে বাংলাদেশ বলেছে, তারা কোনও অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত নেবে না।
এই পদক্ষেপ আইনি দিক থেকে যতই যুক্তিযুক্ত হোক, বাস্তবে এটি একটি ‘রাজনৈতিক ঘোষণা’, যা ২০২৬ অসম বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। নাগরিকত্ব বিতর্ক, ধর্মীয় মেরুকরণ, বাংলাদেশি অভিবাসী নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ—সবকিছুকে এক প্যাকেজে বেঁধে বিজেপি এবার নতুন চাল খেলছে।