দোলযাত্রা হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব। ভারতীয়দের অনেক উৎসবের মধ্যে সকলের পছন্দের তালিকায় প্রথমের দিকেই থাকে দোল বা হোলি। প্রায় গোটা দেশ জুড়ে সাড়ম্বরে পালন করা হয় এই উৎসব। উত্তর ভারতে এই উৎসবের নাম হোলি, অনেক জায়গায় একে হোরি-ও বলা হয়। এই উৎসব বসন্ত, প্রেম এবং রঙের উৎসব নামেও পরিচিত ৷ দোল পূর্ণিমা হিন্দু ধর্মের জন্যে খুব শুভ বলে মনে করা হয়। সাধারণত ফাল্গুন মাসেই হয় দোল উৎসব। এই বিশেষ দিন উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পুজো হয়। জেনে নিন এবছরের দোলযাত্রার নির্ঘণ্ট।
দোল ও হোলির দিনক্ষণ
এই বছর দোলযাত্রা পড়েছে ১৪ মার্চ (বাংলায় ২৯ ফাল্গুন)। এই দিনটিকে বসন্ত উৎসবও বলা হয়। হোলি সাধারণত দোলের পরের দিন পালিত হয়। তবে এবছর হোলি উৎসব পড়েছে ১৪ মার্চ। ১৩ মার্চ সকাল ১০/২৪ মিনিট থেকে ১৪ মার্চ সকাল ১১/৩৫ মিনিট পর্যন্ত এই বছর পূর্ণিমা থাকবে।
হোলিকা দহন- ন্যাড়া পোড়া রীতি কবে?
হোলিকা দহন উৎসব হয় গোটা উত্তর ভারত জুড়ে। মনের কালিমাকে দূরে সরিয়ে আলোর উজ্জ্বলতায় জীবনকে ভরিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতির জন্যে বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয়। এবছর ন্যাড়া পোড়া বা হোলিকা দহন হবে ১৩ মার্চ।
দেশজুড়ে রঙের উৎসব উদযাপন
দোলযাত্রা উৎসবে রাধা ও কৃষ্ণের শাশ্বত ও ঐশ্বরিক প্রেম উদযাপন করা হয়। এদিন রাধা-কৃষ্ণের পুজো করা হয় বিশেষত। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, দোল পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীনীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। ভারতের ব্রজ অঞ্চলে, যেখানে কৃষ্ণ ছোট থেকে বড় হয়, সেখানে রাধা ও কৃষ্ণের স্বর্গীয় ভালোবাসার স্মৃতি হিসেবে দিনটি রাঙা পঞ্চমী হিসেবে উদযাপিত হয়।
বসন্তের সূচনার সঙ্গে হোলি প্রেমের উৎসব হিসেবে দিনটি পালিত হয়। ঋষি গর্গের রচিত গর্গ সংহিতায় ছিল সাহিত্যের প্রথম কাজ যেখানে রাধা ও কৃষ্ণের হোলি খেলার বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। দোল উপলক্ষে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি হিসেবে পরিচিত মথুরা ও রাধার জন্মস্থান বৃন্দাবনে প্রায় ১৬ দিন ধরে বিশেষ উৎসব পালিত হয়। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী আরও একাধিক স্থানে সকলে মেতে ওঠেন রঙের উৎসবে।
পশ্চিমবঙ্গের কোথায় বিশেষভাবে পালন হয় দোলযাত্রা?
শান্তিনিকেতন: শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত উৎসব চালু করেছিলেন। তাই রঙিন এই উৎসবের দিকে মুখিয়ে থাকেন অনেকেই। সমগ্র শান্তিনিকেতনবাসী তো বটেই, সেই সঙ্গে বিশেষ উৎসব হয় কবিগুরুর বিশ্বভারতীতে। আগের দিন রাতে ও বসন্ত উৎসবের দিন সকালে বৈতালিক হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রীরা কাঠি নাচ ও বসন্তের গানে-নাচে উদযাপন করেন ঋতুরাজ বসন্তকে। মহিলারা পরেন হলুদ শাড়ি ও পুরুষেরা সাদা পাজামা-পঞ্জাবি। গলায় থাকে উত্তরীয়। আবিরের রঙে আরও বেশি করে রঙিন হয়ে ওঠে রাঙা মাটির দেশ। প্রতি বছর এই বসন্ত উৎসবের টানে এখানে ভিড় জমাতেন লক্ষাধিক লক্ষাধিক ট্যুরিস্ট। যদিও গত কয়েক বছরের মতো এবারও বিশ্বভারতীর বসন্ত উৎসব হচ্ছে শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার্থে।
নবদ্বীপ: এই দিনই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি বলে জানা যায়। বিশেষ উৎসব পালিত হয় হিন্দু বঙ্গ সমাজে। সর্বত্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও রাধা- কৃষ্ণের পুজো করা হয় বিশেষত। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, দোল পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীনীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই জন্যে নবদ্বীপেও আয়োজন করা হয় বিশেষ দোল উৎসবের। আবির খেলায় মেতে ওঠেন সকলে। নদীয়া জেলার এই পবিত্র স্থানেও ট্যুরিস্ট ও পুণ্যার্থীরা হাজির হন।
মায়াপুর: পবিত্র মায়াপুরের ইস্কনের মন্দিরে দেশ-বিদেশের থেকে লোকেরা আসেন দোল উৎসবে। প্রায় একমাস আগে থেকে চলে এখানে প্রস্তুতি। কৃষ্ণপ্রেমী বিদেশীরাও রঙের উৎসবে সামিল হল আনন্দ ও নিষ্ঠার সঙ্গে।
নিমদিহি: পুরুলিয়া জেলার নিমদিহিতে দোলের সময়ে বিশেষ লোক উৎসব হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে আগত ট্যুরিস্টরা লোকশিল্প উপভোগ করতে পারেন এই সময়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছৌ নাচ, দরবারি ঝুমুর, নাটুয়া নাচ, বাউল গান। মূলত বসন্তকেই উদযাপন করা হয় এই সময়ে।
মদন মোহন মন্দির: বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে মদনমোহন মন্দিরটি এই অঞ্চলে সবচেয়ে সুপরিচিত। ১৬০০ খ্রীস্টাব্দের শেষ দিকে রাজা রাজা দুর্জান সিং দেব এই মন্দিরের নির্মাণ করেছিলেন। হিন্দু ধর্মীয় বই, রামায়ণ এবং মহাভারত ইত্যাদি মন্দিরের দেয়ালগুলিতে খোদাই করা আছে। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধাকে সম্মান জানাতে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। তাই প্রতি বছর দোলযাত্রায় এখানে বিশেষ উৎসব পালিত হয়।