রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একাধারে ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, হুগলীর কামারপুকুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। আজ তাঁর ১৮৫ তম জন্মদিন।
গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পৌরোহিত্য গ্রহণের পর তিনি দেবী কালীর আরাধনা শুরু করেন।
তাঁর জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা, যা অনেকেরই অজানা।
রামকৃষ্ণদেবের জন্মের পূর্বে মা চন্দ্রমণি দেবী, দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত একটি জ্যোতি তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে। তাঁর জন্মের আগে গয়ায় তীর্থভ্রমণে গিয়ে তাঁর বাবা ক্ষুদিরাম, গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দেখেন। সেই কারণে তিনি নবজাতকের নাম রাখেন গদাধর। যা পরে 'গদাই'-নামে রূপান্তর হয়।
গদাই নামে পরিচিত গদাধর তাঁর গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। সে যুগে ব্রাহ্মণসমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি 'চালকলা-বাঁধা বিদ্যা' অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা-উপার্জনী শিক্ষা বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন।
তবে পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাঁর ঔদাসিন্য থাকলেও নতুন কিছু শিখতে তাঁর আগ্রহ ছিল। তাছাড়াও গানবাজনা, ধর্মীয় উপাখ্যান ও কথকতা অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি পারদর্শী ছিলেন।
তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পুরাণকথকদের থেকে শুনে অতি অল্প বয়সেই গদাধর রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত গীতাতে বুৎপত্তি অর্জন করেন। মাতৃভাষা বাংলায় তার অক্ষরজ্ঞান ছিল। তবে সংস্কৃত অনুধাবনে সক্ষম হলেও, সেই ভাষা তিনি বলতে পারতেন না।
১৮৫৫ সালে কলকাতার রানি রাসমণি, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ধীরে ধীরে রামকৃষ্ণদেব সেই মন্দিরের পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন।
মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম দিকে তাঁকে একটি ছোটো ঘর দেওয়া হয়। এই ঘরেই তিনি তাঁর বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন।
শোনা যায় রানি রাসমণির জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস ওরফে মথুর বাবু,গদাধরকে 'রামকৃষ্ণ' নামটি দিয়েছিলেন। আবার অন্য মতে শোনা যায়, এই নামটি তাঁর অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।
তাঁর পরিবারের লোকেরা ভাবেছিলেন, তিনি আধ্যাত্মিক দিকে মন দিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। তাই তাঁদের ধারণা হয়, বিয়ের পর সাংসারিক দায়-দায়িত্বের ভার কাঁধে চাপলে আধ্যাত্ম সাধনার মোহ কেটে যাবে। তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে আসবেন।
এই ভাবনা থেকেই জয়রামবাটী গ্রামের সারদার সঙ্গে তাঁর শাস্ত্র মতে বিয়ে হয়। তাঁদের এই বিয়ের সময়ে সারদার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। অন্যদিকে রামকৃষ্ণ ছিলেন ২৩ বছরের যুবক। বিয়ের পর তিনি ফের দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসেন।
সারদা দেবীকে তিনি দিব্য মাতৃকাজ্ঞানে পুজো করেছিলেন। এমনকি তাঁকে দেবী কালীর পীঠে বসিয়ে ফুল ও ধূপ দিয়েও পুজো করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি বলতেন যে, নারী মাত্রই জগজ্জননীর রূপ। তাই তাঁর নিজের স্ত্রীও এর ব্যতিক্রম নয়। দাম্পত্য জীবনে সারদা দেবীকে মাতৃজ্ঞান করায় তাঁদের বিয়ে অসাধারণত্ব লাভ করে।
১৮৭৯ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিজের প্রধান শিষ্যদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাক্ষাৎ হয়। তাঁর গৃহস্থ শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয়কুমার সেন প্রমুখরা। এছাড়া ত্যাগী বা সন্ন্যাসী শিষ্য ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), রাখালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল (স্বামী শিবানন্দ), শশীভূষণ চক্রবর্তী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী (স্বামী সারদানন্দ) প্রমুখরা।
১৮৮৫ সালের অগস্ট মাসে একদিন হঠাৎ তাঁর গলা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সেই সময়ের প্রখ্যাত চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁকে দেখে বলেন, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। সারদা দেবীসহ অন্যান্যরা তাঁর সেবা-যত্ন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৮৮৬ সালের ১৬ অগস্ট ৫০ বছর বয়সে, কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তিনি দেহত্যাগ করেন।
(ছবি সৌজন্য: গেটি ইমেজ, অ্যালান পেরি ও ফেসবুক)