যুগ যুগ ধরে বাংলার বুকে হয়ে আসছে কালী-সাধনা। রামপ্রসাদ সেন থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, এ বঙ্গে মাতৃ-আরাধনার ইতিহাস সুদীর্ঘ। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন এই কালীপুজোর সূচনা কার হাত ধরে? এই বাংলার বুকে প্রথম যে মানুষটি কালী পুজো করেন তিনি হলেন কৃষ্ণানন্দ আগামবাগীশ (Krishnananda Agamavagisha)। সেটিই ছিল প্রাচীনতম দক্ষিণাকালীর পুজো। পরবর্তীকালে তাঁরই দেখানো পথে বাংলা তথা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে কালী পুজো।
প্রথম কালী মূর্তি গঠন
কৃষ্ণানন্দ আগামবাগীশের জন্ম নদিয়ার নবদ্বীপে (Nadia Nabadwip)। তাঁর আসল পদবি অবশ্য ভট্টাচার্য। তবে তন্ত্র সাধনার আগম পদ্ধতিতে সিদ্ধিলাভ করে তিনি আগমবাগীশ উপাধি পান। তিনি যে কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন, তার নেপথ্যেও রয়েছে বিশেষ এক কাহিনি। শোনা যায়, একসময় পুজোয় বসে দেবীর কাছে আগমবাগীশ আর্জি জানান, "এ বার সাকার রূপে দেখা দাও মা, মূর্তি গড়ে তোমার অর্চনা করি।" কৃষ্ণানন্দের সেই কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী বিধান দেন, রাত্রি শেষে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীকে দেখবেন, সেই মতোই হবে তাঁর যথার্থ সাকার মূর্তি। পরের দিন ভোরে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে কৃষ্ণানন্দ দেখলেন, এক দরিদ্র বধূ গাছের গুঁড়ির উপর একমনে ঘুঁটে দিচ্ছেন। বাঁ হাতে গোবরের মস্ত তাল, ডান হাত উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিচ্ছেন। সেই বধূর গায়ের রং ছিল কালো, বসন আলুথালু, লম্বা চুল। কনুই দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে সিঁদুর লেপ্টে গিয়েছে। এহেন অবস্থায় পরপুরুষ কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটেন সেই বধূ। ব্যাস, এরপরেই কৃষ্ণানন্দের মনে ভেসে ওঠে দেবী প্রতিমার অবয়ব। সেই মতোই গঙ্গামাটি নিয়ে মূর্তি গড়তে বসেন কৃষ্ণানন্দ। তাঁর তৈরি সেই মূর্তিই পরবর্তীতে বাংলায় মা কালী রূপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কেউ কেউ বলেন আগমবাগীশের নাকি অনেক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। শোনা যায়, একবার কোনও এক ধনীর বাড়িতে দুর্গাপুজো করতে গিয়েছিলেন আগমবাগীশ। পুজোর শেষে বাড়ির কর্তা নিজের অহংবোধের বশবর্তী হয়ে কৃষ্ণানন্দকে বলেন যে তিনি প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেননি। সেই কথা শুনে রীতিমতো রেগে যান কৃষ্ণানন্দ। আগমবাগীশ বলেন, যদি তিনি প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন কিনা তখনই তার প্রমাণ দেবেন। কিন্তু তিনিও এও বলেন, প্রমাণ দেওয়ার পর সেই বাড়ির কেউ আর জীবিত থাকবেন না। গৃহকর্তা সম্মতি জানানোর পর কৃষ্ণানন্দ একটি কুশি ছুঁড়ে দেন দেবী প্রতিমার ঊরুতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমার ঊরু ফেটে রক্তপাত হয়। আর সেই মুহূর্তেই মুখে রক্ত উঠে মৃত্যু হয় পরিবারের প্রত্যেকের।
রামপ্রসাদের গুরু আগমবাগীশ
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সময়কাল নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক। কারও মতে আবার তাঁর জন্ম আরও কিছুটা পরে। সাধক রামপ্রসাদ সেনেরও তন্ত্রগুরু ছিলেন আগামবাগীশ। 'বৃহৎ তন্ত্রসার' (Brihat Tantrasara) নামে একটি বইও রচনা করেন তিনি। আগামবাগীশ যে দেবীর পুজোর প্রচলন করেন তিনি আগমেশ্বরী মাতা (Agameswari Kali) নামে পরিচিত। নদিয়ার নবদ্বীপে আজও তাঁর পুজো হয়।
আরও পড়ুন - শ্মশানে অশরীরী তান্ত্রিকের কাছে দীক্ষার পরেই কালীর দেখা পান কমলাকান্ত