জাতপাতের রাজনীতি ভারতে নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই ধারা, যা আজও বিদ্যমান। আর জাতপাতের রাজনীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। দিনে দিনে ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম চালিকাশক্তি যেন হয়ে উঠছে জাতপাত। জাতপাতনির্ভর এই রাজনীতি থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেননি এদেশর রাজনীতিকেরা। বিশেষ করে গোবলয়ের রাজনীতিতে সব সময় জাতপাতের সমীকরণই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। উত্তর প্রদেশ ও বিহারে তো বটেই, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতএ কোনো রাজ্যই এই জাতপাতের অঙ্কের বাইরে আজও বেরোতে পারেনি। রাজনীতিকে এই বলয়ের বাইরে বের করার চেষ্টা যারা করেছিল, সেই বামপন্থীরা নিজেরাই ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। পশ্চিমবঙ্গে এতদিন জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতি দেখা যায়নি। তবে একুশের ভোটে জাতপাতের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে কিনা সেই নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে সরাসরি জাতপাতের কোনও প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। যদিও বাংলার সমাজ-জীবনে জাতপাতের প্রবল উপস্থিতি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ছিল। এরাজ্যে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের নিয়ে অল্পবিস্তর সংগঠিত রাজনীতি দেখা গেলেও সেভাবে কংগ্রেস বা বাম দলগুলি কখনোই জাতভিত্তিক রাজনীতি করেনি। বাম এবং কংগ্রেস উভয় দলের ক্ষেত্রেই সমাজের সব জাতির মানুষের সমর্থন কমবেশি ছিল। যেভাবে মায়াবতীর সঙ্গে দলিতদের সম্পর্ক, মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে যাদব ভোটারদের সম্পর্ক বা অজিত সিংয়ের সঙ্গে জাঠ ভোটারদের সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গে তেমন সম্পর্ক রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে জাতের দেখা যায় না। বিধানচন্দ্র রায় থেকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পর্যন্ত সকলেই জাতের রাজনীতির বাইরে থেকে রাজ্য-রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে বামেরা মূলত শ্রেণীগত রাজনীতির ওপর ভিত্তি করেই নিজেদের সংগঠিত করেছেন। তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য আলাদা করে গণসংগঠন গড়ে তুললেও নির্বাচনী রাজনীতিতে কংগ্রেস বা বামেরা কখনওই নির্বাচনী প্রচারে তাদের আত্মপরিচয়কে ব্যবহার করেনি। বরং সরকারে থাকার সুবিধায় রাজ্য বা কেন্দ্রের তরফ থেকে তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের জন্য যে সমস্ত কল্যাণকর প্রকল্প রূপায়ণ করতে পেরেছে তার ভিত্তিতেই শাসক দল যেমন সমর্থন আদায় করতে চেয়েছে, তেমনি বিরোধীরা তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষের উন্নয়নের কাজে সরকারের ব্যর্থতাকে সামনে রেখে সংরক্ষিত আসনগুলি জেতার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে সেই চেনা ছক অনেকটাই পাল্টাতে শুরু করেছে। একদিন বাংলায় ভোট যুদ্ধ থাকলেও নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে এমন উত্তেজনা চোখে পড়েনি। এবার ২০২০ সালের শেষ থেকেই সব শিবিব ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর এই মহাযুদ্ধে সুচারু ভাবে জাতপাতের রাজনীতিকে ব্যবহার করতে চাইছে সব শিবিরই।
বিজেপির গেমপ্ল্যান-
বাম জমানায় পিছড়ে বর্গ হিসাবে পরিচিত মতুয়া সম্প্রদায়ের মন জয় করে মোক্ষম রাজনৈতিক চাল দিয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার জেরে টলে গিয়েছিল বামেদের রাজনৈতিক ভিত৷ একের পর এক ভোটে তার সুফল কুড়িয়েছে তৃণমূল৷ পঞ্চায়েত, পুরসভা, লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া-ভোটের সিংহভাগই গিয়েছে তৃণমূলের পকেটে৷ সেই চেনা ছকেই রাজ্য রাজনীতিতে জমি পাকাপোক্ত করতে কোমর বেঁধে নেমেছে বিজেপি৷ গত লোকসভা ভোটে তার সুফলও পয়েছে গেরুয়া শিবির। রানাঘাট ও বনগাঁর মত মতুয়া অধ্যুষিত এলাকায় ফুটেছে পদ্ম। এবারও সেই মতুয়া ভোটকে টার্গেট করেই এগোচ্ছে গেরুয়া শিবির। কারণ পিরসংখ্যান বলছে ৩০টি বিধানসভা আসনের ফলাফল এদিক-ওদিক করে দিতে পারেন গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামীরা। সেই কারণেই আগামী বঙ্গ সফরে এসেছে ঠাকুরনগরে যাবেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
নবান্ন দখলে আদিবাসী ভোটও প্রয়োজন বিজেপির। পরিসংখ্যান বলছে রাজ্যের একাধিক জেলায় গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে আদিবাসীদের অধিকাংশ ভোট ঝুঁকেছিল বিজেপির দিকে। বিধানসভা ভোটে সাফল্য পেতে তাই আদিবাসী ভোটেই নজর গেরুয়া শিবিরের। তাই প্রতিবার রাজ্য সফরে এসে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতাদের দেখা যাচ্ছে আদিবাসী পরিবারগুলিতে মধ্যাহ্নভোজ সারতে। উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে জঙ্গলমহল থেকে উত্তরবঙ্গ রাজ্যের সবপ্রান্তের এই আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ককে টার্গেট করছে গেরুয়া শিবির।
অঙ্ক কষছে তৃণমূলও-
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকেই মতুয়াদের ভোটদানের প্রবণতায় স্পষ্টভাবে তৃণমূলের প্রতি ঝোঁক ধরা পড়েছিল। শেষবেলায় বামেরা বিমান বসুকে নামিয়েও মতুয়া সম্প্রদায়ের তৃণমূলের প্রতি এই ঝোঁককে ঠেকাতে পারেনি। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে তৃণমূলের প্রতি মতুয়াদের স্পষ্ট সমর্থন ধরা পড়ে। সেই মতুয়া ভোটে গত লোকসভা নির্বাচনে ভালরকম ভাগ বসিয়েছে বিজেপি। একুশের বিধানসভা ভোটের আগে মতুয়া মন পেতে তাই বাড়তি তৎপর শাসক তৃণমূল।
২০১১ এবং ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যের পেছনে আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের অবদান মানতেই হবে। তাই নিজের কার্যকালে বারবার জঙ্গলমহল ও পাহাড় সফর করতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। গত লোকসভা নির্বাচনে আদিবাসী ভোট কেন তৃণমূল থেকে সরে গেল, তা বুঝতে তৃণমূলের হয়ে ময়দানে নেমেছিল ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর। তাই আদিবাসী পাড়ায় জনসংযোগের বিষয়টিতে এবার বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে ঘাসফুল শিবির।
মুসলিম ভোট এবার কোন দিকে?
গত দশ বছরে পরপর দুইটি বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটকোন দিকে গেছে, তা জানার জন্য সবজান্তা গুগল বা কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। রাজ্যের যে কোনো বঙ্গসন্তানকে জিজ্ঞাসা করলেই তিনি নির্দ্বিধায় উত্তর দেবেন, তৃণমূলের কাছে। ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রায় ১০০টি আসনের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিতে পারে ৩০ মুসলিম মুসলিম ভোট। কাজেই ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস যেমন এই ভোট নিজের দিকে ধরে রাখতে সচেষ্ট, তেমনই হিন্দুত্ববাদী বিজেপিও তৎপর সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে।
শুরু চুলচেরা বিশ্লেষণ-
সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারীকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘নন্দীগ্রামে ৪০ শতাংশ মুসলিম ভোট আছে। জিতবেন কীভাবে! সংখ্যালঘুরা ভোট দেবে না। জিততে কষ্ট হবে।’ এতেই স্পষ্ট জাতরাতের মত ধর্ম নিয়ে রাজনীতিও বাংলায় ক্রমেই শেকড় আরও শক্ত করছে। সৌগতর কটাক্ষের জবাব সম্প্রতি খেজুরির জনসভায় দিতে দেখা যায় শিশির পুত্রকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা করতেই তৃণমূল সুপ্রিমোকে চ্যলেঞ্জ করে শুভেন্দু বলেছিলেন, 'আপনি কার ভরসায় নন্দীগ্রামে জিতবেন? ৬২ হাজারের ভরসায়? এখানে তো জয় শ্রী রাম বলেন, ২ লক্ষ ১৩ হাজার ভোটার৷।‘ তৃণমূনেত্রীর সভাকে হায়দরাবাদের আসাদউদ্দিন ওবেইসির সভা বলে কটাক্ষ করতেও দেখা যায় শুভেন্দুকে। স্পষ্টতই দুই তরফই প্রকাশ্যে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলা শুরু করে দিয়েছে।