Advertisement

বলা হত 'কাঁথির মুখ্যমন্ত্রী', একসময় ছেলের মত শিশিরও হয়েছিলেন বিদ্রোহী

বাম বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন শিশির অধিকারী। ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা।সাতের দশকে তিনি কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হন। তার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে অধিকারী পরিবারের হাতেই রয়েছে কাঁথি।

Sisir Adhikari
সুমনা সরকার
  • কলকাতা,
  • 18 Mar 2021,
  • अपडेटेड 5:47 PM IST
  • শিশির অধিকারীর রাজনৈতিক জীবন অর্ধশতকেরও বেশি
  • সাতের দশক থেকে ধারাবাহিক ভাবে অধিকারী পরিবারের হাতেই রয়েছে কাঁথি
  • শুভেন্দুর উত্থানের নেপথ্যে শিশির অধিকারীর তৈরি করে রাখা জমিরও কম অবদান নেই

কাঁথির শান্তিকুঞ্জের মেজ ছেলে গত বছর ডিসেম্বরেই বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। এর কয়েকদিন পরে শুভেন্দু অধিকারীর ছোট ভাই সৌমেন্দুও দাদার পথই অনুসরণ করেন। তবে অশীতিপর রাজনীতিক শিশির অধিকারী ও তাঁর আরেক ছেলে তথা তমলুকের বিধায়ক  দিব্যেন্দু অধিকারী এখনও খাতায় কলমে তৃণমূল শিবিরেই রয়েছেন। তবে ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে বইছে তাতে শান্তিকুঞ্জে ফের পদ্ম ফোটা কিন্তু সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে হচ্ছে। আর তা যদি হয় তাহলে বর্ষীয়াণ শিশিরবাবু জীবনে দ্বিতীয়বার দলবদল করতে চলেছেন। দীর্ঘিদন ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিশির অধিকারীর মধ্যে রয়েছে দাদা-বোনের সম্পর্ক। মমতা ছিলেন শিশিরের কাছে 'বোন', আর মমতার কাছে তিনি 'শিশির দা'। সেই সম্পর্ক অবশেষে তিক্ততায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা দুই তরফের বাক্যবাণেই স্পষ্ট।  যে অধিকারী পরিবারের হাত ধরে বাম আমলেই পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূল আধিপত্য বিস্তার করেছিল বলে দাবি করা হয়, তাঁদের এবার দলে অস্তত্বি না থাকা কিন্তু তৃণমূলের কাছে একুশের ভোটে সাংগঠনিক দিক থেকে  বড় চ্যালেঞ্জ। শিশির-শুভেন্দুদের অধিকারী পরিবারের যে নিজস্ব সাংগঠনিক দাপট রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে, তা তৃণমূলে বিরল। শুভেন্দুর উত্থানের নেপথ্যে তাঁর নিজস্ব দক্ষতা এবং ক্যারিশমা যেমন বড় ফ্যাক্টর, তেমনই রয়েছে বাবা শিশির অধিকারীর তৈরি করে রাখা জমিও। শিশির অধিকারীকে একসময় কাঁথির মুখ্যমন্ত্রী বলা হত। সাতের দশকে তিনি কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হন। তার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে অধিকারী পরিবারের হাতেই রয়েছে কাঁথি। সেই মহিরুহ সমান শিশিরবাবুর রঙবদলে পূর্ব মেদিনীপুরে কী প্রভাব পড়বে একুশের ভোটের আবহে আপাতত তার বিশ্লেষণেই ব্যস্ত রয়েছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। 

ভিড় নেই শাহ'দের সভায়, জঙ্গলমহলে কোন অশনিসঙ্কেত BJP-র

বকলমে কাঁথির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন!
শিশির অধিকারীর  রাজনৈতিক জীবন অর্ধশতকেরও বেশি।  একসময়  শিশির অধিকারীকে বলা হত কাঁথির মুখ্যমন্ত্রী। এতটাই প্রভাব ছিল তাঁর। যেমন একসময় হলদিয়ায় প্রভাব ছিল সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা লক্ষ্মণ শেঠের। সিপিএম ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর লক্ষ্মণ শেঠ ক্রমশ অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছেন রাজনীতিতে। কিন্তু শিশির অধিকারী কখনোই ক্ষমতার অলিন্দের বাইরে থাকেননি। বরং তাঁর রাজনৈতিক সাম্রাজ্য ক্রমশ বেড়েছে। বামফ্রন্টের দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের ক্ষমতাকালেও শিশিরবাবু কিন্তু ছিলেন স্বমহিমায় বিরাজমান।

Advertisement

 বিদ্রোহী হয়েছিলেন শিশিরও
বাম বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন শিশির অধিকারী। ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা।সাতের দশকে তিনি কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হন। ১৯৮২ সালে শিশির প্রথমবার দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক হন। কিন্তু ১৯৮৭ সালে তাঁকে টিকিট দেয়নি দল। সেইসময়ের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ওই কেন্দ্রে তাঁর অনুগামীকে দাঁড় করান। শিশির অধিকারী প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন প্রিয়রঞ্জনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। নিজে নির্দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। অনেকেই বলে থাকেন বাবার সেই বিদ্রোহী স্বভাবই পেয়েছেন পরিবারের মেজো ছেলেটি।

'জঙ্গলমহলের মা' থেকে সম্পর্ক তলানিতে, তাল কেটেছিল কিসে?

চিন্তাভাবনার পর যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে
১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন। সেই সময় শিশির অধিকারীর পরিবার তৃণমূলে যোগ দেয়নি।  কংগ্রেসেই থেকে গিয়েছিলেন। জানা যায় তখন শিশিরবাবু নাকি ভীষণ দোলাচলে ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী যেমন ভি ভি গিরির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটাকে ভেঙে নিজের দিকে টেনে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেভাবে প্রদেশ কংগ্রেসের মূলস্রোতটাকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন কি না তাই দেখছিলেন রাজনীতিতে পোরখাওয়া শিশির অধিকারীর। সেবারের ভোটে কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে লড়ে শিশির তৃতীয় স্থান পান।  ১৯৯৯ সালে যখন দেখলেন প্রদেশ কংগ্রেসের মূল স্রোত ক্রমশ মমতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তখনই ছেলে শুভেন্দুকে নিয়ে তিনি তৃণমূলে যোগ  দেন। ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে কাঁথি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী নীতীশ সেনগুপ্ত জিতেছিলেন। সেই জয়ে বড় ভূমিকা ছিল শিশির-শুভেন্দুর। তারপর দুই দশকেরও বেশি সময় তৃণমূলেই কেটেছে তার। এবং ক্ষমতার বৃত্তের মধ্যেই। ২০০১ সালে শিশিরকে দক্ষিণ কাঁথি এবং শুভেন্দুকে মুগবেড়িয়া বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেন মমতা। শিশির দু’দশক পরে ফের বিধায়ক হলেও বামফ্রন্ট প্রার্থী এবং তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের কাছে হেরে যান শুভেন্দু। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে দক্ষিণ কাঁথি কেন্দ্রটি মেজ ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে শিশির এগরায় প্রার্থী হন। জেতেন দু’জনেই। প্রথম বার বিধায়ক হন শুভেন্দু। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে তমলুকে লক্ষ্মণ শেঠকে  হারিয়ে প্রথম বার সাংসদ হন শুভেন্দু। কাঁথি কেন্দ্রে জিতে প্রথম সাংসদ হন শিশিরও। প্রথমবার কেন্দ্রের মনমোহন সরকারের প্রতিমন্ত্রী হন শিশির অধিকারী। 

কাঁথিতে অধিকারী রাজ
২০১১-র বিধানসভা ভোটে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের সব ক’টিতেই জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস। কাঁথি দক্ষিণের বিধায়ক হন শুভেন্দুর সেজ ভাই দিব্যেন্দু। ছোট ভাই সৌমেন্দু কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ফের পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি এবং তমলুক কেন্দ্রে জেতেন শিশির-শুভেন্দু। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটেও সেই ধারা বজায় ছিল। কাঁথি  ও তমলুক থেকে জেতেন শিশির ও তাঁর সেজো ছেলে দিব্যেন্দু অধিকারী। তার আগে ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে জিতে শুভেন্দুর মমতা মন্ত্রিসভায় প্রবেশ।  কাঁথি থেকে ক্রমশ পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেই অধিকারী পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব ছড়িয়েছে। লোকে মজা করে বলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা অধিকারী পরিবারের সাম্রাজ্য। এখানে ওরাই শেষ কথা। ভালো মন্দ যা কিছু সব অধিকারী  পরিবারের কারো না কারো অঙ্গুলিহেলনে হয়ে থাকে।

Advertisement

মোদীর সভায় এবার শিশির?
কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সুবাদে কেন্দ্রের মন্ত্রী। প্রায় দু’দশক পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি। এখনও তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ। শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তাঁর পরিবার নিয়ে একটা অস্থির অবস্থা চলছে। ছোট ছেলে সৌমেন্দু শুভেন্দুকে অনুসরণ করে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। আর এক ছেলে দিব্যেন্দু এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের সাংসদ। শিশিরবাবুরা বরাবরই রাজনৈতিকভাবে এক পরিবার। যদিও শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর শিশির অথিকারী বলেছিলেন  শুভেন্দু তার নিজের মতো রাজনীতি করে আমাকে কিছু জানায় না। তবে এক যাত্রায় পৃথক ফল ঘটার সম্ভাবনা কম। ক্রমেই সেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগামী ২৪ মার্চ কাঁথিতে নরেন্দ্র মোদীর সভায় উপস্থিত থাকবেন শিশির অধিকারী। বুধবার চণ্ডীপুরের সভা থেকে এই মন্তব্য করেছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী স্বয়ং। সম্প্রতি লকেট চট্টোপাধ্যায় 'শান্তিকুঞ্জে' গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভায় উপস্থিত থাকার জন্য শিশির অধিকারীকে আমন্ত্রণ করে এসেছেন। শিশির অধিকারী নিজেও সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন, 'ছেলে বললে নিশ্চয় যাব। আমাকে সুযোগ দিলে না যাওয়ার তো কিছু নেই।' উল্লেখ্য শুভেন্দু দল ছাড়ার পর মমতা এবং তৃণমূলের অন্যান্য নেতারা পূর্ব মেদিনীপুরে জনসভা করতে এলেও সেখানে কিন্তু শিশিরবাবু বা তাঁর সেজো ছেলেকে দেখা যায়নি। বিজেপিতে যোগ দিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় শুভেন্দু বলেছিলেন, 'আমার বাড়ির লোকেরা পদ্ম ফোটাবে।' অবশেষে তা সত্যি হতে চলেছে।  সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে গোটা অধিকারী পরিবারই যে এবার পদ্মতলে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু সেদিকেই  দিক নির্দেশ করছে।

 

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement