
SIR ও NRC তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে? প্রশ্নটা উঠছে,যখন দেখা যাচ্ছে, SIR নিয়ে জেলায় জেলায় নানা রকম ঘটনা ও আতঙ্ক। ভোটার তালিকা সংশোধনে স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন (SIR) চলছে পশ্চিবঙ্গে।কেন্দ্রীয় সরকার বা নির্বাচন কমিশন NRC নিয়ে কিছু না বললেও, SIR-কে NRC ভাবছেন বহু মানুষ। আবার SIR প্রক্রিয়া চলাকালীনও নানা ঘটনার খবর আসছে। কোথাও কাজের চাপে BLO আত্মঘাতী, কোথাও অভিযোগ উঠছে, BLO-রা স্থানীয় ক্লাবে তৃণমূল কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে SIR প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। সবচেয়ে বিচিত্র পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকাগুলিতে। প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে বাংলাদেশ ফিরে যাওয়ার জন্য। তাঁদের তো একেবারে 'ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি' অবস্থা। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে SIR ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষকে এনুমারেশন ফর্ম বিলি করা হয়ে গিয়েছে। এবার ফর্ম জমা নেওয়া শুরু হবে। ইতিমধ্যেই UIDAI আবার কমিশনকে বড় তথ্য দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৩৪ লক্ষ নাম বাদ যেতে পারে। UIDAI-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩৪ লক্ষ আধারধারী নাগরিককে 'মৃত' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজ্যের প্রায় ১.৩ লক্ষ মানুষের কখনও আধার কার্ড ছিল না, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনিক নথিতে তাঁদের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক, পশ্চিমবঙ্গে SIR প্রক্রিয়া ঘিরে ঠিক কী কী চলছে।
১. পুরপ্রধানের নামে দু’টি EPIC কার্ড
বারুইপুর পুরসভার চারবারের চেয়ারম্যান শক্তি রায়চৌধুরীর নামে দু’টি EPIC কার্ড থাকা নিয়ে নয়া বিতর্ক। এসআইআর ফর্মও এসেছে দু’টি, একটিতে তিনি ফিলআপও করেছেন। শক্তির দাবি, তাঁকে ও তৃণমূলকে বদনাম করা উদ্দেশ্য এই সব চলছে। তাঁর স্ত্রী–মেয়ের নামেও ভুলভাবে SIR ফর্ম এসেছে বলে দাবি। এটা শক্তির দোষ নয়, নির্বাচন কমিশনের গাফিলতি। বিএলও স্বীকার করেছেন, শক্তির নামে দুটি ফর্মই এসেছে, একটি তিনি দিয়েছেন, আরেকটি ফেরত দেবেন।
২. রামপুরহাট: BLO–দের বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি
SIR ডেটা এন্ট্রি বাতিলের দাবিতে রামপুরহাটে BLO–রা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তাঁদের দাবি, ডেটা এন্ট্রির জন্য তাঁরা প্রশিক্ষিত নন। বহু BLO–র কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেই স্থায়ী ইন্টারনেট। ভুলভ্রান্তির আশঙ্কা বাড়ছে। তাঁদের দাবি, অভিজ্ঞ ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগ করা হোক।
৩. বসিরহাট হাকিমপুর সীমান্তে বাংলাদেশিদের ফিরে যাওয়ার হিড়িক
দীর্ঘদিন নথিহীনভাবে নিউটাউনে বাস, ভ্যান চালানো, ইটভাটায় কাজ, বহু বাংলাদেশি SIR শুরু হতেই ফিরে যেতে শুরু করেছেন। কারও কাছে আধার–ভোটার কার্ড নেই, পাসপোর্ট–ভিসারও ছাপ নেই। নিজেরাই স্বীকার করছে, অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে নানা রকম পেশায় সব নিযুক্ত ছিল। কেউ ২ বছর, কেউ ১০ বছরেরও বেশি ভারতে ছিলেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, ২০ বছর ধরে ভারতে এই ভাবেই থাকছিলেন।
৪. ৩০০ বাংলাদেশি নাগরিক আটক
সোমবার সকালে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের কাছে হাকিমপুর চেকপোস্টে প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশি নাগরিক, পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে আটক করে বিএসএফ। পশ্চিমবঙ্গে চলা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়া চলাকালীন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা হতে পারে, এই আশঙ্কাতেই তাঁরা একসঙ্গে দেশে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে জানা গিয়েছে। সূত্রের দাবি, এই বিশাল দলটিকে আটক করে বিএসএফ সদস্যরা আলাদা করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন। সব তথ্য যাচাই করে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ কী হবে, তা ঠিক করা হবে।
৫. আদিবাসীদের মধ্যে SIR ফর্ম ঘিরে আতঙ্ক
জঙ্গলমহলের অতি দুর্গম শবর গ্রামগুলিতে SIR ফর্ম পৌঁছতেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গ্রামের ৭০টি পরিবারে এখনও পাকা রাস্তা, জল, ঘর, কিছুই নেই। অধিকাংশই নিরক্ষর, ফর্ম কীভাবে পূরণ করবেন জানেন না। তাঁদের আশঙ্কা, ফর্মে ভুল হলে সরকারি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।
৬. জয়নগরে শতাধিক বাসিন্দার ভোটাধিকার সঙ্কট
তিন–চার পুরুষ ধরে বসবাস, পুরনো জমির দলিল থাকা সত্ত্বেও ২০০২ ভোটার তালিকায় নাম নেই জয়নগরে বহু মানুষের। আগের ও পরের তালিকায় নাম রয়েছে। প্রয়োজনীয় ১১টি নথির একটিও নেই। ফলে SIR নিয়ে তীব্র আতঙ্ক। তৃণমূলের হুঁশিয়ারি, একজনের ভোটাধিকারও হারাতে দেব না। বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূল মিথ্যা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
৭. BLO পৌঁছতেই উধাও ভোটাররা
নদিয়ায় সীমান্তবর্তী মুসলিম পাড়ায় BLO পৌঁছতেই অনেকেই বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন খোদ BLO। খালের দুপারে দুই দেশের গ্রাম, সহজ যাতায়াত, বহু বাংলাদেশি বিয়ে করে ভারতে থাকেন। ভোট দিয়েছেন আগে, কিন্তু SIR ফর্ম দিতে গিয়ে কেউই বাড়িতে নেই। BJP বলছে, এটাই প্রমাণ, তৃণমূলের মদতেই দুই দেশের নাগরিকত্ব চলেছে।
৮. অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে BLO অসুস্থ, কেউ আবার আত্মঘাতী
SIR আতঙ্কে একাধিক আত্মহত্যার ঘটনার পাশাপাশি কাজের চাপে অনেক BLO অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে, তখন জলপাইগুড়ির মালবাজার থেকে খবর এল, শান্তিমণি এক্কা নামে মহিলা বিএলও আত্মঘাতী হয়েছেন। পরিবারের দাবি, তিনি এসআইআর-এর কাজ করতে রাজি ছিলেন না। তাঁকে নির্বাচন কমিশন জোর করে এই কাজ করাচ্ছিল। মানসিক চাপে আত্মঘাতী হয়েছেন।