প্রয়াত রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মূলত শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এদিন ভোর রাতে অবস্থার অবনতি হয়। সকাল ৮.২০ মিনিটে জীবনাবসান হয় কমরেড বুদ্ধদেবের। রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম জমানার দ্বিতীয় ও শেষ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
জানা গিয়েছে, কদিন ধরেই জ্বর ছিল। বুধবার বাড়িতে রক্তপরীক্ষাও করা হয়। বাড়িতেই চিকিত্সা চলছিল তাঁর। কারণ হাসপাতালে থাকতে পছন্দ করতেন না তিনি। আজ সকালে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল অনেকটা কমে যায়। তারপরই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় বলে পারিবারিক সূত্রে খবর। বালিগঞ্জে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই সকাল ৮টা ২০ মিনিট নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
রেখে গেলেন স্ত্রী ও এক সন্তানকে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবন। প্রথমে কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়ান। ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা এই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন বুদ্ধবাবু।
অনেকের মুখে বারবার ঘুরেফিরে আসছে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সাদামাটা জীবনযাপনের কথা। ৫৯এ, পাম অ্যাভিনিউ ফ্ল্যাটে এখনও সেই পুরনো লেটার বক্স। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকে প্রাক্তন হয়েও একতলার দুকামরার ফ্ল্যাটেই থাকতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য।
৫৯এ পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন, একটানা ২৪ বছর ছিলেন বিধায়ক। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পেরিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং-এ পৌঁছে গেলেও ঠিকানা বদলাননি কখনও।
কেন এত টান ওই বাড়ির প্রতি, কী আছে পাম অ্যাভিনিউ-এর ওই ফ্ল্যাটে? এক সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন সে কথা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর চাইলেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারতেন তিনি। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, ‘পুরনো অভ্যাস’ ছাড়তে পারেন না। কোনও অভ্যাসই না। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার বই, আমার টেবিল.. ছেড়ে আসতে পারবো না। অসুবিধা হবে আমার।”
তিনি তখন মুখ্যমন্ত্রী। দেশি, বিদেশি অতিথি, শিল্পপতিদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। সেই প্রয়োজনে রাইটার্সেই বেশি সময় কাটাতেন তিনি। দরকার হলে দিন রাত পড়ে থাকতেন অফিসে, কিন্তু নিজের বাড়ি নিয়ে কোনও আপোষ নয়।
বাড়ির প্রতি কেন এত টান? বোঝাতে গিয়ে বুদ্ধবাবু ওই সাক্ষাৎকারে বলছেন, “সেই কলেজে লাইফ থেকে যে ধরণের পোশাক পরতাম, এখনও তেমন পরি। যা খেতে পছন্দ করতাম, এখনও তাই খাই। যে ভাবে আড্ডা মারতাম, সেভাবেই আড্ডা মারি। ওটাই আমার সামাজিক স্তর। খুব বড়, একটা সাজানো গোছানো ঘরে গেলে আমার অস্বস্তি হবে, মনে হবে ফিশ আউট অব ওয়াটার।” শুধু তাই নয়, বুদ্ধবাবু বক্তব্য ছিল, তিনি খুব স্বাধীনতাপ্রেমী। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গোঁড়া নই, খুব স্বাধীনতা প্রেমী। ওই ঘরে থাকাটাও আমার একটা স্বাধীনতা।’
মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি যে টালির চালের, এ কথা সবারই জানা। অনেকেই মনে করেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’ এটা বোঝাতেই অনেক নেতা নেত্রী বিলাস ব্যাসনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। কিন্তু সেই তুলনা মানতে রাজি ছিলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য। তিনি জানিয়েছিলেন, অতিথিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর আলাদা ব্যবস্থা আছে তাঁর। ফলে বাড়ি ছোট হলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা ছিল না।
বুদ্ধবাবুর পরিবারও সবসময় তাঁর এই সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য বা সন্তান সুচেতনা ওই ঘরেই কাটিয়েছেন বরাবর। সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য বলেছিলেন, ‘ওরা খুব খুশি। মেয়ে আমাকে তিন বার বলেছে, বাবা একদম বাড়ি ছেড়ে যাবে না।’ আজ সেই বাড়ি ছেড়েই চিরতরে চলে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।