মঙ্গলবার ভারতে পালিত হতে চলেছে ঈদ। এদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। পাক্কা দুবছর সেভাবে পালিত বতে পারেনি ঈদ। কিন্তু এবার পরিস্থিতি বদলেছে। ২ বছর পর, রেড রোডে ঈদের নামাজ পরার অনুমতি মিলেছে। আর এই বিশেষ দিনের জন্য সেজে উঠছে নাখোদা মসজিদও।
কলকাতা চিৎপুর অঞ্চলে অবস্থিত নাখোদা মসজিদ কলকাতার প্রধান মসজিদ। মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে রবীন্দ্র সরণি ধরে দক্ষিণমুখী ৫ মিনিটের পথে জাকারিয়া স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই নাখোদা মসজিদ। কলকাতার নাখোদা মসজিদ ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানদের সর্ববৃহৎ উপাসনালয়। মোগল সম্রাট আকবরের সমাধির আদলে লাল বেলে পাথর আর আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি এই মসজিদই অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে বড় মসজিদ ছিল।
১০০ ফুট উচ্চতার ২৫টি ছোট মিনার, ১৫০ ফুট উচ্চতার দু’টি বড় মিনারসহ দুর্লভ গ্রানাইট পাথর দিয়ে নির্মিত সুবিশাল দ্বিতল চাতালে সজ্জিত হয়েছে এই মসজিদ। মূল ভবনে একসঙ্গে ১৫ হাজার মুসলিম নামাজ আদায় করতে পারেন। ঈদের দিনে চাতালগুলোর ভরপুর সমাগমে লাখের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়।
ফারসি ভাষায় নাখোদা শব্দের অর্থ জাহাজের নাবিক বা যিনি জাহাজযোগে মালপত্র আমদানি-রপ্তানির কাজ করেন। কলকাতার বুকে এই "নাখোদা মসজিদ" সম্বন্ধে বই পুস্তক ঘেঁটে যে ইতিবৃত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা এই রকম - গুজরাট প্রদেশের কচ্ছের একটি ক্ষুদ্র সুন্নি সম্প্রদায় মুসলিম "কাচ্ছি মেমন জামাত"। তাদের নেতা আব্দুর রহিম ওসমান ছিলেন পেশায় সমুদ্র বণিক। তিনিই এই মসজিদ তৈরির অর্থ প্রদান করেন। অর্থাৎ এক মল্লার নাও চালানো, তার নামে - অনুকরণে মসজিদটির নামকরণ হয় "নাখোদা মসজিদ"।
১৯২৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটের সংযোগস্থলে নির্মাণকাজ শুরু হয় এই মসজিদের। বণিক আবদুর রহমান ওসমান নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে তৎকালীন সময়ে ১৫ লাখ টাকা নির্মাণ খরচ বহন করেছিলেন এই মসজিদের জন্য, যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক শ’ কোটি টাকার মতো। মেনন সম্প্রদায় কলকাতায় বসবাস শুরু করে ১৮২০ সালের দিকে। তারা বেশিরভাগ জাহাজ, চিনি ও অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশেষ প্রতিপত্তি ও বিপুল বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। দিনে দিনে তারা কলকাতা শহরের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলেন আধুনিক কলকাতার নানা রূপ-বৈচিত্র্য। তাদের অবদানেরই সাক্ষী এই নাখোদা মসজিদ।
মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। তৎকালীন সময়ের সর্ববৃহৎ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনটোশ বার্ন কোম্পানি বিহারের তোলেপুর থেকে গ্রানাইট পাথর এনে ইন্দো-সেরাসেনিক পদ্ধতিতে সম্পাদন করে এই সুবিশাল নির্মাণযজ্ঞ। শ্বেতপাথরে গড়া মসজিদের ভেতরের অংশ তাজমহলের কথা মনে করিয়ে দেয়। মসজিদের প্রধান ফটক বানানো হয়েছে মোগল সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার আদলে।
নাখোদা মসজিদ স্থাপত্যের দিক থেকে এক বিস্ময়। সূক্ষ্ম অলংকরণ, শৈল্পিক কল্পনার এক অনন্য নিদর্শন। সাদা মার্বেলের দেয়াল, বেলজিয়াম কাচ, বিশাল নামাজের জায়গা, দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কাঠের ঘড়ি। দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের গন্ধ। ভারত সরকার ২০০৮ সালে মসজিদটিকে হেরিটেজ বিল্ডিং বা ঐতিহ্যবাহী ভবনের মর্যাদা দিয়েছে। বর্তমানে এটি শুধু মুসলমানদের উপাসনালয়ই নয়, পর্যটকদের কাছেও এটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
অনেকেই বলেন, নাখোদা মসজিদ লাগোয়া চিৎপুর রোডের প্রতিটা কোণে কোণে পাওয়া যায় বাদশাহি মেজাজ৷ সুতোর কাজ করা জামাকাপড় থেকে শুরু করে সুরামা, আতর, অম্বুরি তামাক, মোগলাই খানা– যেন সময় থমকে আছে৷ কলকাতার নাখোদা মসজিদটি পরিদর্শন করতে আপনি সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত যে কোনও সময়ে যেতে পারেন। এর জন্য কোনও প্রবেশমূল্যের প্রয়োজন নেই।