কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লাকে পাশে নিয়ে শনিবারই বিজেপি রাজ্য সভাপতি মন্তব্য করেছিলেন বাংলা ভাগের দাবি অবৈধ নয়। যা নিয়ে দলের অন্দরেই এখন ঝড় উঠেছে। একুশের বিধানসভা নির্বাচন মিটতেই উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য করার দাবি তুলেছিলেন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী জন বার্লা । গত শনিবার জলপাইগুড়িতে তাঁর পাশে বসে আলাদা রাজ্যের দাবি উস্কে দিতে দেখা যায় স্বয়ং দিলীপ ঘোষকে(Dilip Ghosh)। উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি জঙ্গলমহলেও বঞ্চনার অভিযোগ তোলেন দিলীপ ঘোষ। গত জুন পৃথক জঙ্গলমহলের কথা বলেছিলেন বিষ্ণপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। শোনা যায় সেই সময়ে দলীয় বৈঠকে সৌমিত্রকে ভর্ৎসনা করেছিলেন দিলীপ। উল্টে দিলীপবাবুকে বলতে শোনা গিয়েছিল সৌমিত্রের এই ধরনের মন্তব্য দল কোনওভাবেই সমর্থন করে না। এবার সেই দিলীপ ঘোষকে বাংলা ভাগের দাবিতে সায় দিতে দেখেই দলের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এমনকি দিলীপ পন্থী হিসাবে যারা পরিচিতি তাঁদেরও সরব হতে দেখা গেছে। এমনিতেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি দলের অন্দরে যথেষ্ট কোণঠাসা বলেই শোনা যায়। তার ওপর নয়া বিতর্ক তৈরি করে তিনি কি নিজের রাস্তা আরও দুর্গম করে ফেললেন? সেই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে।
বঙ্গভাগ নিয়ে রবিবার সায়ন্তন বসুকে প্রশ্ন করা হলে বিজেপি নেতা বলেছিলেন এটা কারও ব্যক্তিগত মতামত হতে পারে, কিন্তু দল সমর্থন করে না। সায়ন্তন কারও বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি । তবে সেই ধারা বজায় রাখলেন না দলের আর দুই নেতা-নেত্রী। পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবির বিরোধিতায় সরব হয়েছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা ও হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। রাখি বন্ধনের দিন দিলীপের নাম না করেই রাহুল বলেন, "রাখির সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এখনও বঙ্গভঙ্গ করতে চায় একদল মানুষ। বাংলার নাম পাল্টে দিতে চায়। রাজ্যকে ভৌগলিক ভাবে ভাগ করতে চায়। এটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবমাননা।" প্রসঙ্গত ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রাহুলকে সরিয়েই বিজেপির রাজ্য সভাপতি হয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ। দলের অন্দরের খবর তারপর রাহুল ও দিলীপের সম্পর্কে একটা শীতলতা বরাবরই ছিল। দিলীপের কাছে গদি হারানোর ব্যথা হয়তো ভুলতে পারেননি রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি। তাই বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গে উত্তরসূরীকে প্রকাশ্যে বিঁধতে ছাড়েননি। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যের হল লকেটের বেসুরো গাওয়া।
২০১৭ সালে দলের মহিলা মোর্চার সভানেত্রীর পদে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে সরিয়ে সেখানে লকেট চট্টোপাধ্যায়কে নিযুক্ত করেছিল রাজ্য বিজেপি। দিলীপ ঘোষের হাত ধরেই হয়েছিল গোটা কর্মকাণ্ড। তারপর থেকেই দলে দিলীপ ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিতি রয়েছে লকেটের। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া লকেটের বাড়ি গিয়ে ফোঁটা নেওয়া বা রাখি পূর্ণিমায় দিন বিজেপি সাংসদের থেকে রাজ্য সভাপতির রাখি পরা, সবসময়ই চর্চায় থেকেছে। বঙ্গভাগের বিষয়ে সেই লকেটের গলাতেও এবার শোনা গেল ভিন্নসুর। চুঁচুড়ায় রাখিবন্ধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে লকেট চট্টোপাধ্যায় দিলীপবাবুদের বাংলা ভাগের মন্তব্যের বিরোধিতা করেন। তিনি পরিষ্কার বলে দেন যে, বাংলা কখনও ভাগ হবে না।
দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন বিজেপির যে উত্থান হয়েছে বঙ্গে, সে কথা অনস্বীকার্য। তবে একুশের ভোটে তাদের স্বপ্নপূরণ হয়নি। যে অদম্য বাসনা নিয়ে বিজেপি এবার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বঙ্গ-বিজয়ে, তা বাংলার মানুষ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাই দিলীপ বিজেপিকে উত্থানের পথ দেখালেও কাঙ্খিত সাফল্য না মেলায়, ভোটের পর তাঁকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন বিজেপির নেতা-নেত্রীদের একাংশ। শোনা যাচ্ছে বঙ্গ বিজেপিতে দিলীপ ঘোষ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। মুকুল রায় বিজেপিতে থাকাকালীন দিলীপের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল বলে শোনা যায়। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেও দিলীপ ঘোষের যে চাপা টেনশন রয়েছে তা ভালই বোঝা যায় দুই নেতার আচরণে। সৌমিত্র খাঁর সঙ্গেও একাধিকবার মতবিরোধ হয়েছে দিলীপের। তথাগত রায়তো একাধিকবার তাঁকে ট্যুইটে বিঁধেছেন। এমন কী দলের ছোট ও মাঝারিমাপের নেতারাও সরব হতে পিছপা হচ্ছেন না দিলীপের বিরুদ্ধে। এই আবহে বঙ্গভঙ্গের জল্পনা উস্কে দলের অন্দরে দিলীপ নিজেকে আরও কোণঠাসা করে ফেললেন কিনা সেই প্রশ্নই উঠছে। যদিও দলের অন্দরে ভিন্নসুর বুঝতে পেরেই অবস্থান বদল করে নিয়েছেন দিলীপ। সোমবার সকালে ইকো পার্কে প্রাতঃভ্রমণের সময়ে সংবাদ মাধ্যমের সামনে তিনি দাবি করেন, বঙ্গভঙ্গের কথা মোটেও বলেননি। এই অবস্থায় বিজেপি কি নির্ধারিত সময়ের আগে রাজ্যের সভাপতি পরিবর্তন করবে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।