আর কোনও রাখঢাক নেই। ৩০ সেপ্টেম্বর ভবানীপুরে হতে চলা উপনির্বাচনে তিনিই যে প্রার্থী হবেন তা রবিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে নাম ঘোষণার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য ব্যানার, হোর্ডিং, ফ্লেক্স পড়ে গিয়েছিল ভবানীপুর জুড়ে। একুশের বিধানসভা ভোটে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। একদা সহযোগী বর্তমানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কাছে সেই প্রেস্টিজ ফাইটে জোর লড়াই হয়েছিল দু'জনের। তবে সামান্য কিছু ভোটের ব্যবধানে শুভেন্দুকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকেই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কোন আসন থেকে উপনির্বাচনে লড়বেন। মাঝখানে শোনা গিয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার খড়দা থেকেও ভোটে লড়তে পারনে তৃণমূলনেত্রী। কিন্তু ভবানীপুর আসন থেকে সদ্য বিধায়ক হওয়া শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল নিজের পুরনো কেন্দ্রের ওপরেই আস্থা রাখতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আবহে ভবানীপুর থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছে দলীয় নেতৃত্ব। কিন্তু গত ১০ বছরে এই বিধানসভার ভোটের ট্রেন্ড কী বলছে? চলুন দেখে নেওয়া যাক।
২০১১ সালে ভবানীপুরের ফল
২০২১ অর্থাৎ বাংলায় পরিবর্তনের বছর। সেবার রাজ্য জুড়ে বয়ে গিয়েছিলে জোড়াফুলের ঝড়। ব্যতিক্রম ছিল না ভবানীপুরও। ২০১১ সালে এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রথমে টিকিট দিয়েছিল বর্তমানে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সিকে। তিনি পেয়েছিলেন ৮৭ হাজার ৯০৩ ভোট। সিপিএমের নারায়ণ প্রসাদ জৈনকে হারিয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৯৩৬ ভোটের ব্যবধানে। সুব্রতবাবু পেয়েছিলেন ৬৪.৭৭ শতাংশ ভোট। সিপিএম প্রার্থী জৈন পেয়েছিলেন ২৭.৯৭ শতাংশ। বিজেপি প্রার্থী রামচন্দ্র জয়সওয়ালের দখলে ছিল মাত্র ৫ হাজার ৭৮টি ভোট।
ভবানীপুর থেকেই প্রথমবার বিধায়ক হন মমতা
২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে জিতে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময়ে তিনি ছিলেন সাংসদ। ফলে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উপনির্বাচনে লড়তে হয়েছিল তৃণমূল নেত্রীকে। ভবানীপুর কেন্দ্রটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মমতা। প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচনে লড়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। সেবার মমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পান ৭৩,৬৩৫ ভোট। আর নন্দিনী মুখোপাধ্যায় পান ১৯,৪২২ ভোট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫৪ হাজার ২১৩ ভোটে জয়ী হন। মমতা ভোট পেয়েছিলেন ৭৭.৪৬ শতাংশ। সিপিএমের ঝুলিতে যায় মাত্র ২০.৪৩ শতাংশ ভোট।
২০১৬-তেও ভবানীপুরেই ভরসা
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও এই কেন্দ্রেই প্রার্থী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার তিনি পেয়েছিলেন ৬৫ হাজার ৫২০ ভোট। শতকরা হিসেবে ৪৮.৫৩ শতাংশ। কংগ্রেস জোটের প্রার্থী ছিলেন দীপা দাশমুন্সি। তাঁকে ২৫ হাজার ৩০১ ভোটে হারিয়েছিলেন মমতা। দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন ৪০,২১৯টি ভোট। বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়েছিলেন নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্রকুমার বসু। তিনি পেয়েছিলেন ২৬ হাজার ২৯৯ ভোট। শতকরা হিসেবে ১৯.৪৮ শতাংশ। বিজেপির ভোট প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছিল।
২০২১-এর বিধানসভা ভোট
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমে ভবানীপুর ও নন্দীগ্রাম উভয় কেন্দ্র থেকেই প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে শুধু নন্দীগ্রামে প্রার্থী হন তিনি। তাঁর জায়গায় ভবানীপুর থেকে তৃণমূল দাঁড় করায় শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে। শোভনদেব পান মোট ৭৩ হাজার ৫০৫ ভোট। একুশের ভোটে এই কেন্দ্রে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষকে প্রার্থী করে চমক দিয়েছিল বিজেপি। তবে রুদ্রর ঝুলিতে যায় ৪৪,৭৮৬ ভোট। শোভনবাবু রুদ্রনীলকে হারান প্রায় ২৮ হাজারের কাছাকাছি ভোটে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী কংগ্রেসের সাদাব খান পান মাত্র ৫২১১ ভোট। তৃণমূল এখানে পায় ৫৭.৭১ শতাংশ ভোট। বিজেপি পায় ৩৫.১৬ শতাংশ ভোট। আর কংগ্রেস পায় মাত্র ৪.০৯ শতাংশ ভোট।
লোকসভা ও ভবানীপুর
বিধানসভায় বরাবর ঘাসফুলের জয়জয়কার হলেও ভবানীপুর কেন্দ্রে লোকসভায় কিন্তু চিত্রটায় বেশ বদল ঘটেছিল। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হন তৃণমূলের সুব্রত বক্সী। বিধানসভাওয়াড়ি ফলাফলে ভবানীপুরে বিজেপির থেকে ১৭৬ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন সুব্রত। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ভবানীপুর বিধানসভা এলাকায় কংগ্রেস পেয়েছিল ১৫,৪৮৪ ভোট। সিপিএম ২১,৯৫৪ ভোট। তৃণমূল ৪৭,২৮০ ও এবং বিজেপি ৪৭,৪৫৬টি ভোট। ফলে লোকসভা ভোটের ফলাফল বলছে, নিজের কেন্দ্রেই ভোট সংখ্যার বিচারে পিছিয়ে পড়েন তৃণমূল সুপ্রিমো। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। দক্ষিণ কলকাতায় লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হন মালা রায়। ভবানীপুরে কড়া টক্কর দেয় বিজেপি। বাম ও কংগ্রেস জোট ১৩ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিল। তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও বিজেপির ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ৩ হাজার ১৬৮। অর্থাত্ গত লোকসভা ভোটের দিকে তাকালে ভবানীপুর কেন্দ্রের ভোটচিত্র কিন্তু মাথাব্যথার কারণ ছিল তৃণমূলের।
গত ৩ দশকে ভবানীপুর ছাড়েননি তৃণমূল সুপ্রিমো
পরিসংখ্যান বসছে গত তিন দশক ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুর ছেড়ে যাননি। ১৯৯১ থেকে ২০১১ কলকাতা দক্ষিণের সাংসদ ছিলেন তিনি। যে কেন্দ্রের মধ্যে ভবানীপুরও ছিল। ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ভবানীপুরের বিধায়ক পদ সামলেছেন মমতা। কিন্তু একুশের বিধানসভায় নিজের সেই চেনা আসন ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। ওই কেন্দ্রে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ হিন্দি ভাষী। তবে একুশের ভোটে সব সমীকরণ বুমেরাং করে দিয়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর প্রথম নির্বাচন হচ্ছে রাজ্যে। আর ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের যা ট্রেন্ড, তাতে ২০১১ থেকেই এখানে অন্তত ২৫ হাজারের কম ভটে জেতেনি তৃণমূল প্রার্থী। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার তার ব্যতিক্রম হবে না। তারমধ্যে আবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী হওয়ায় ভবানীপুর থেকে একটা রেকর্ড হতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ।