Advertisement

মমতার সঙ্গে অভিষেকের সংঘাত তৈরি হয়েছে? বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল

অধুনা মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের মধ্যে কি সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে? এরকম একটা প্রশ্ন অনেকেই করছেন! রক্তের সম্পর্ক থাকলেও রাজনীতিতে ইগোর সংঘাত, কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মাতপার্থক্য তো কোনও অস্বাভাবিক নয়!

মমতা ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায়মমতা ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায়
জয়ন্ত ঘোষাল
  • কলকাতা,
  • 15 Jan 2022,
  • अपडेटेड 4:28 PM IST
  • রাজনীতি কোনও স্থিতিশীল ধারণা নয়, রাজনীতি গতিশীল ধারণা
  • রাজনীতির বহতা স্রোত কোথা থেকে শুরু হয় কোথায় এসে শেষ হয়, সে এক গভীর অধ্যায়নের বিষয়
  • রাজনীতিতে কোনও পূর্ণচ্ছেদ নেই

রাজনীতি কোনও স্থিতিশীল ধারণা নয়, রাজনীতি গতিশীল ধারণা। রাজনীতির বহতা স্রোত কোথা থেকে শুরু হয় কোথায় এসে শেষ হয়, সে এক গভীর অধ্যায়নের বিষয়। 

রাজনীতিতে কোনও পূর্ণচ্ছেদ নেই। তাই রাজনীতিতে দলের শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কের গতিশীলতা বোঝা সবসময় সোজা হয় না! এই সম্পর্কের ভিতর অনেক স্তর এবং জটিলতা থাকে। সবসময় সেটাকে খুব সহজ ভাবে বুঝতে গেলে ভ্রম হয়। 

আরও পড়ুন

অধুনা মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের মধ্যে কি সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে? এরকম একটা প্রশ্ন অনেকেই করছেন! রক্তের সম্পর্ক থাকলেও রাজনীতিতে ইগোর সংঘাত, কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মাতপার্থক্য তো কোনও অস্বাভাবিক নয়! গুরু-শিষ্যের সংঘাতের কিন্তু বহু দৃষ্টান্ত আছে ঐতিহাসিক ভাবে।

মমতা  বন্দোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায় রাজনীতির মধ্যে সত্যি সত্যিই কি কোনও চূড়ান্ত  মতপার্থক্য বা সংঘাত-সমন্বয়ের অভাব ইত্যাদি ইত্যাদি দেখা দিয়েছে কি না, এই রকমের প্রশ্নের সম্মুখীন বার বার হতে হচ্ছে। এমনকী সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল থেকেও এ প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে হতে হচ্ছে।

আমার এক প্রবীণ সম্পাদক বলেছিলেন যে গুঞ্জন আর খবর- তার মধ্যে তফাৎটা  কোথায়? খবরের সত্যতা যাচাই করা যায় এবং সেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় এভিডেন্সিয়াল ট্রুথ। কিন্তু গসিপ হচ্ছে সেইটা যেটার প্রমাণ নেই, যেটা কানে কানে প্রচারিত হয় এবং যেটাকে আমরা অনেক সময় গুজব বলি, যেটাকে অনেক সময় ঘরোয়া আড্ডায় পরনিন্দা পরচর্চার সংস্কৃতি বলি। সেগুলো কিন্তু লোকে অনেক সময় আগ্রহ সহকারে শোনে। অতীতে কলকাতা পুরসভায় একটা পত্রিকা বেরত নাম ছিল বসন্তক !

বিষয়বস্তুই ছিল কাউন্সিলরদের কেচ্ছা এবং তাঁদের নিয়ে গসিপ। এমনকী রাষ্ট্রগুরু  সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও পর্যন্ত ছাড় পাননি। তাঁর সম্পর্কেও বলা হয়েছিল যে তিনি ইংরেজদের  সঙ্গে বোঝাপড়া করে তাঁর বাড়ির সামনে কূপ খনন করিয়েছিলেন। যাতে জলটা সবসময় তার বাড়ির সামনে পাওয়া যায়। এমনকী তখনকার সময়ের পরিবহণের জন্য জরুরি ঘোড়ার আস্তাবল সেটাও উনি তার বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া জমিতে করেছিলেন। এগুলো পরে দেখা গেছে সব সত্যি নয় !

Advertisement

আমি আমার সম্পাদকের কাছে শুনেছি বিদেশে গসিপ এডিটরের পদ  হয়েছে, যাঁরা খালি এই ধরণের গসিপ লিখে থাকেন। কিন্তু গসিপ না হলেও আজকাল বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ভাইরাল হয়ে যাওয়া নানান রকমের গল্প কথা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। সেই কারণে সাংবাদিকদের এটাও কর্তব্য যে জিনিসটাকে না এড়িয়ে গিয়ে তার সুষ্ঠু রাজনৈতিক একটা বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করা। 

মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কোনও সংঘাত আছে বলে আমি মনে করিনা! কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে এই ফেনোমেনানটা।

দেখুন অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদবানি- একজন প্রধানমন্ত্রী এবং একজন উপপ্রধান মন্ত্রী। সেই সময় ভীষণ ভাবে প্রচারিত ধারণা  ছিল যে দু'জনের মধ্যে সাংঘাতিক ঝগড়া। দু'জনের আলাদা আলাদা গোষ্ঠী তৈরী হয়েছিল এবং আমি নিজে সাংবাদিক হিসাবে দেখেছি তার মধ্যে সত্যতা ছিল। 

দু'জন ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিন্তু সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। বাজপেয়ীর জন্মদিনে প্রথম আদবানি যেতেন তাঁর সাথে দেখা করতে এবং যত দিন বেঁচে ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত আর কাউকে তিনি চিনতে পারুন বা না পারুন ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে তাঁর জন্মদিন ছিল তিনি আদবানিজিকে প্রথম দেখতেন। বাজপেয়ী এবং আদবানির মধ্যে বয়সের তফাৎ খুব কম ছিল, মাত্র দু'বছরের তফাৎ। ফলে সেই সময় সংঘাতটা  আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

কারণ দু'জনেই প্রায় সমসাময়িক। কিন্তু আমি একবার আডবানিজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনাদের সম্পর্কে এতো গুজব রটে যে একজন আর একজনের বিরোধী এবং দু'জনের আলাদা আলাদা গোষ্ঠী, এমনকী কল্যাণ সিং যিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং আদবানি ঘনিষ্ঠ, তাঁকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আবার সুন্দর সিং বাঘেলা যিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ, একজন আদবানি বিরোধী আর একজন বাজপেয়ী বিরোধী কিন্তু দু'জনেই বরখাস্ত হয়েছিলেন।

আদবাণিজির কাছে এর কারণ জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন যে, ওই তাঁর যে অনুগত কল্যাণ সিং বাজপেয়ীজির বিরুদ্ধে বলছে এবং বিরোধীতা করছে, তখন কিন্তু আদবানিই কল্যাণ সিংকে বরখাস্ত করলেন। আবার যখন বাজপেয়ী ঘনিষ্ঠ বাঘেলা আদবানির বিরোধিতা করলেন গুজরাট রাজনীতিতে (উল্লেখ্য আদবানি সাংসদ সদস্য ছিলেন গুজরাট থেকে আর বাজপেয়ী ছিলেন লখনউ থেকে) তখন বাঘেলাকে কিন্তু বরখাস্ত বাজপেয়ীই করেছিলেন, তাঁর অনুগত হওয়া সত্ত্বেও, আদবানি কে অশ্রদ্ধা করেছিলেন বলে।

সুতরাং অনেক সময় এই গোষ্ঠী রাজনীতিটা নেতারা তৈরি করেন না, কিছু অনুগত, যাদের বলা যায় স্তাবক, তারা মনে করে যে একজনকে ধরে, তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়ে, আর এক জন নেতার বিরোধীতা করে খুব দ্রুত যদি রাজনীতিতে কিছু উত্থান হয়। কিন্তু তাতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বিপদ বাড়ে। 

বাজপেয়ী আদবানির ক্ষেত্রে, আদবানি বলেছিলেন যে তিনি যদি কারও নাম বাজপেয়ীর আগে সুপারিশ করতেন, সে রাজ্যপালই হোক বা কোনও সচিব, বাজপেয়ী সেটা মেনে নিতেন। আবার বাজপেয়ী যদি কোনও নাম আগে থাকতে ওঁকে বলতেন, উনি তখন নিজের সুপারিশের নাম সেখানে বলতেন না। এরকম একটা মিউচুয়াল মেকানিজম দু'জনের মধ্যে ছিল

মোদী-আমিত শাহ দু'জনের মধ্যে কিন্তু অনেকে বলে ব্যবধান বেড়েছে। গোষ্ঠী আলাদা হয়ে গেছে। এমনকি গুজরাটের একজন সাংবাদিক আমাকে বলেছেন যে, একসঙ্গে মোদী এবং অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক হওয়া যায় না। যে কোনও একজনের ঘনিষ্ঠ হওয়া যেতে পারে। কারণ দুজনের মধ্যে ব্যবধান আছে। এমনকি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একজন নেতা বলেছেন যে এই গুরু শিষ্য সম্পর্কটা এমনই যে প্রধানমন্ত্রী যদি অমিত শাহকে বলেন যে পঞ্চাশ তলা থেকে এখনই ঝাঁপ দাও, উনি ঝাঁপ দেবেন। এমনই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। 

Advertisement

কিন্তু তাই বলে কি দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক নেই? ফারাক আছে। বহু ক্ষেত্রে পন্থারও তফাৎ রয়েছে কিন্তু একে অন্যের পরিপূরক এবং কোথাও একটা সাঘাতিক বোঝাপড়া আছে এবং যেহেতু বয়সের ব্যবধানটা অনেক মোদী এবং অমিত শাহর, প্রায় দশ বছরের বেশি, সেক্ষেত্রে কিন্তু বাজপেয়ী আদবানির মধ্যে যে কনফ্লিক্টটা ছিল, এক্ষেত্রে আরও নেই। এক্ষেত্রে মোদীজি নির্দেশ দেন এবং অমিত শাহ সেটাকে মানেন, কেন না বয়সের ব্যবধানটা অনেকখানি।
 
এগুলোতো অন্যরকম। কিন্তু মমতা আর অভিষেকের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেককে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে তৈরি করছেন এবং নিজে হাতে তিনি তাঁকে সেই রাজনৈতিক পরিসরটা দিয়েছেন এবং অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের এটাই হচ্ছে অসাধারণ যোগ্যতা যে সকলে তো সুযোগ পেলেও সৎ ব্যবহার করতে পারে না। অভিষেক যে সুযোগটা পেয়েছেন সেটার যোগ্য সৎ ব্যবহার করে আজকে তিনি যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছেন, সেটা কিন্তু দশ পনেরো বছর আগেও আমরা সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতাম না। তাঁর কথাবার্তা, চালচলন, তাঁর ম্যাচিওরিটি, তাঁর যে পরিপক্কতা সেটা অভাবনীয়। 

এখন সেক্ষেত্রে মমতা এবং অভিষেকের মধ্যে কোথাও কোনও মাতপার্থ্যক্য হয়, যদি কোনও দৃষ্টিভঙ্গিগত ফারাক হয়, সেটা তো অসম্ভব কিছু ঘটনা নয়। এতো বাবা-ছেলের মধ্যেও হয় এবং যে কোনও গুরু-শিষ্যের মধ্যেও মতপার্থ্যক  হতে পারে। মতপার্থক্য মানে কিন্তু এই নয় যে দুটো গোষ্ঠী হয়ে যাওয়া বা সংঘাতিক একটা সংঘাত তৈরি করা। সেই সংঘাতের আবহ যারা তৈরি করতে চাইছে, তারা কিন্তু গসিপের কারখানার থেকে উৎপাদন থেকে উৎসাহিত হয়েছে। 

কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, মাতপার্থ্যক্য তৈরি হলেও তাঁরা দু'জনে মিলে বসে আলোচনা করে সেটা সুষ্ঠু  ভাবে সমাধান করে নেবেন। এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যদি তাঁর নিজস্ব কোনও মত প্রতিষ্ঠিত করেন বা তাঁর মত থাকে, সেটা ডায়মন্ড হারবার মডেলই হোক বা অন্য কোনও বিষয় হোক, যে  প্রার্থী কে হবে, সেই মত থাকাটার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই এবং সেটা নিয়ে কোনও প্রকাশ্যে বা তিনি মমতার নামে কোনও মন্তব্য করেননি  বা তাঁর পক্ষে করা সম্ভবও নয়। এবং অনেক জানেন না প্রত্যেক রবিবার যদিও দু'জনেই কলকাতায় থাকেন, তাহলে কালীঘাটের বাড়িতে অভিষেক বিকেল বেলা যান এবং সেটা শুধু পরিবারিক মিলন নয় এবং তাঁদের মধ্যে অন্তত ঘন্টা দু'-তিনেক বিভিন্ন বিষয়ে আলাপআলোচনা হয়। 

একটা খুব ইন্টেরেস্টিং মেকানিজম। কিন্তু দু'জনেরই মধ্যেই আছে, সুতরাং আমি বলব যে যারা মনে করছে যে একটা সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছে এবং তার থেকে কিছু নেপোয় দই মারবে, আমি মনে করি তারা কিন্তু মূর্খের স্বর্গে বাস করছে এবং তাদের কিন্তু বেশি বিপদ হবে।

তারা কিন্তু এই গুরু এবং শিষ্য এবং যেখানে সম্পর্কটা কার্যত মা এবং ছেলের মতো এবং সেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা পারিবারিক সম্পর্কের কথা বলছি না, কেন না অখিলেশ এবং মুলায়মের মধ্যেও কিন্তু মতপার্থক্য এবং বিরোধ হয়েছে এবং মূলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে অখিলেশের এতটাই পার্থক্য হয়েছে যে মুলায়মকে কার্যত গৃহবন্দি করে রেখে দেওয়া হয়েছে।

যাতে পাছে তিনি উল্টোপাল্টা কথা না বলে ফেলেন ইত্যাদি। সুতরাং সেটা কিন্তু পিতাপুত্রের ক্ষেত্রেও সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা প্রশ্নই ওঠেনা। কারণ সাতবার লোকসভা জিতেছেন, তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং এখনও তাঁর মস্তিষ্কের এবং তাঁর যে রাজনীতির আগ্রহ আবেগ এবং তাঁর যা বুদ্ধি বিবেচনা অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদির মতো ব্যাক্তিত্ব কে ২০২১ সালে পরাস্ত করেছেন। 

Advertisement

এবং গোটা ভারত বিস্মিত হয়েছে মমতা বন্দোপাধ্যায়র এই কর্মক্ষমতা দেখে। এখনও কিন্তু অভিষেক বন্দোপাধ্যায়কে মমতা বন্দোপাধ্যায় তৈরি করছেন। অভিষেক অনেক পরিণত হলেও তাঁর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষানবিশিকতার ভূমিকা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সুতরাং এই যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই শেষ  করছি যে এটার একটা ডাইনামিক্স অর্থাৎ গতিশীলতা আছে। এখানে কোনও পূর্ণচ্ছেদ নেই এটা যিনি বুঝবেন না, তাঁরা বুঝতে ভুল করবেন।

 

Read more!
Advertisement
Advertisement