
এক্কেবারে বেআক্কেলে! কোনও মানে হয়? এতখানি বয়সে এসে নাকি আক্কেল হল আমার! তা-ও একটি আস্ত দাঁত উপড়ে ফেলার পর। সে কী মারাত্মক যন্ত্রণা। ছটফট করেছি ব্যথায়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আক্কেল দাঁতের ব্যথা উঠলে ফেলে রাখার ভুলটি মোটে করবেন না। ফল হতে পারে ভয়ানক। তাই 'বেয়ারা' দাঁত বেগড়বাই করার আগেই ঝটপট ডাক্তারবাবুর কথা মতো কাজ সেরে ফেলুন।
পেশাগত কারণে পুজোপার্বণে ছুটি অমিল। তা-ও অফিস সেরে বাড়ি ফিরে নতুন শাড়ি পরে আমি রেডি। সদ্য বিবাহিতা বলে কথা, মানি আর না মানি, শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মীপুজোয় অ্যাটেন্ডেন্স মাস্ট। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম বাঁ দিকের উপরের অবাঞ্ছিত দাঁতে হাল্কা হাল্কা অস্বস্তি শুরু হয়েছে। নাড়ু আমার ফেভারিট। তাই ব্যথার কথা ভুলেই বেশ কয়েকটা টপাটপ মুখে পুড়েছিলাম। কিন্তু গোল বাঁধল ভোগের খিচুড়ি আর ল্যাবড়া খেতে গিয়ে। যন্ত্রণাটা ভালই অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। একঘর লোকের সামনে আমি গাল হাত দিয়ে বসা ছাড়া আর উপায়ও ছিল না।
পরদিন আর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে দেরি করিনি। ডাক্তারের চেম্বারে যখন পৌঁছলাম ব্যথায় গাল ফুলে ঢোল। ডাক্তার বললেন, 'হাঁ করো'। তা করার মতো অবস্থা আর আমার ছিল না। ব্যথায় চোখের সামনে অন্ধকার দেখছিলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উনি জানালেন, আক্কেল দাঁতটি যথেষ্ট অবাঞ্ছিত ভাবে মাড়ি ও হাড়ের মাঝখান দিয়ে উঠে গালে ধাক্কা দিচ্ছে। আর তাতে গালের একাংশের ভাল মতো ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, সার্জারি ছাড়া গতি নেই। চূড়ান্ত যন্ত্রণা থাকায় সে কাজ যদিও তখনই সম্ভব ছিল না। 'আগে ৫ দিন ওষুধ আর অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ব্যথা কমিয়ে এসো।' বললেন ডাক্তার।
এই ৫ দিনে জুটেছে গলা ভাত আর ততধিক গলা সুজি। ফোলা মুখ দিয়ে লিকুইড ছাড়া কিছুই খেতে পারিনি।
আমি যে ভুলটা করে ফেলেছিলাম, ভুলেও সে পথে হাঁটবেন না। ৫ দিনে ব্যথা কমতেই আমি আবার ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। ডাক্তারের পরামর্শ হেলায় উড়িয়ে দিব্যি খাওয়া-দাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। আর যায় কোথায়! 'বেআক্কেলে' দাঁত আবার খেল দেখানো শুরু করল। কখনও মাংস তো কখনও মিষ্টি, সব যেন গোলপোস্টের মতো আটকাতে শুরু করল দাঁতের কোনায়। অগত্যা ফের ব্যথা নিয়ে ছুটলাম ডাক্তারবাবুর চেম্বারে।
আমার ডেন্টিস্ট বেশ 'কুল'। কত সহজেই বলে দিলেন, 'কোনও চিন্তা নেই, মাড়িটা কেটে দাঁতটা তুলে ফেলে দিতে হবে।' শুনে ঢোঁক গিললাম। তবে বিশ্বাস করুন, দাঁতের অসম্ভব যন্ত্রণার কাছে সেটি উপড়ে ফেলার প্রক্রিয়ার ভয় নেহাতই কম। তাই ঠিক করলাম, যা করতে হবে তা-ই করব।
BDS ডা: সঞ্জীত দাস আমার ডেন্টিস্ট। বেহালা জনকল্যাণে, স্মাইলক্রাফ্ট নামে একটি ডেন্টাল ক্লিনিক রয়েছে তাঁর। যেমন সুন্দর চিকিৎসার হাত, তেমনই ভাল ব্যবহার। ডাক্তারের কনফিডেন্সেই আমার অর্ধেক ভয় কেটে গিয়েছিল। তাঁর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী, আমার সমস্যা ছিল আপার লেফট পোস্টে। চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয়, 'বাকাল ইরাপশন ২৮'। যা-ই হোক, সার্জারির আগের দিন আর সেই দিন সকালে ডাক্তারের পরামর্শ মতো 'Moxikind' ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। সঙ্গে কিনে নিয়ে যেতে হয়েছিল একটি 'Tranloke-E' ট্যাবলেট এবং একটি '5Ml Syringe'.
সময়মতো, অনেক সাহস জুটিয়ে পৌঁছে গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে। সঙ্গে অবশ্যই কেউ জানো থাকে, প্রেসক্রিপশনে লিখে দেওয়া হয়েছিল। বাবা-মা দু'জনেই হাজির ছিলেন। প্রথমে হল অ্যানাস্থেশিয়া টেস্ট। স্কিন সেই অ্যানাস্থেশিয়া সহ্য করতে পারবে বুঝে নিয়ে ডাক্তারবাবু আসল প্রক্রিয়া শুরু করলেন। একাধিকবার কুলকুচি করে ফেলতে হল মাউথ ওয়াশ জাতীয় লিকুইড। ডাক্তার বললেন, 'অল ওকে?' আমি মাথা নেড়ে সম্মত্তি জানালাম ঠিকই তবে বুঝতে পারছিলাম বড় বড় সিরিঞ্জগুলো এবার মুখে মধ্যে পুশ করতে চলেছেন তিনি। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। মোট ৩টি ইনজেকশন দেওয়া হলে মাড়িতে। তার মধ্যে একটি সোজা টাগরায়। মিথ্যে বলব না, তেমন একটা ব্যথা অনুভব করিনি।
আধ ঘণ্টার মধ্যে অবশ হয়ে গেল মুখের বাঁ দিকটা। তারপর ফর্সেপ, স্ক্যালপেল নিয়ে মাড়িতে ২-৩ বার কাটাকুটি করে সোজা উপড়ে ফেললেন দাঁতটি। একটি ট্রে-তে উপড়ানো রক্তমাখা দাঁতটি রেখে আমায় দেখালেন। বললেন, 'ডান'। খুব জোর মিনিট ২০ সময় লাগল সবটা হতে। একটি তুলোয় 'Tranloke-E' ট্যাবলেট গুঁড়ো করে সার্জারি হওয়া অংশে চেপে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, ১ ঘণ্টা কথা বলতে না। এরপর তুলো বের করে সঙ্গে সঙ্গে একটি আইসক্রিম খেতে। শুনে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। বেশ কয়েকদিন রোজ আইসক্রিম খাচ্ছিলাম, আরামও মিলছিল।
অ্যানাস্থেশিয়ার ঘোর কাটতে মারাত্মক ব্যাথা হবে। সে ব্যথা ২ দিন অন্তত থাকবেই। এরপর আর কোনও ওষুধ খাওয়ার ঝঞ্ঝাট নেই। তবে উষ্ণ জলে কুলকুচি আর অপেক্ষাকৃত গলা খাবার চালিয়ে যেতে হয়েছে সপ্তাহ খানেক। ঠেকানো যায়নি টুথব্রাশও। এই পর্ব কাটতেই 'বেয়াক্কেলে' দাঁত থেকে চিরতরে মিলেছে রেহাই।