ট্যাটু করতে ইচ্ছে করে! গোড়ালির কাছে উড়ন্ত প্রজাপতি, হাতের কবজির কাছে পালক বা ফুলের নকশা অথবা পিঠ জুড়ে ডানা ছড়ানো ফিনিক্সের ট্যাটু করতে ইচ্ছে করে কি? এই ট্যাটু মোটেই হাল ফ্যাশনের আমদানি নয়। ইতিহাসবিদের মতে, আজ থেকে প্রায় ১৪ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম তার শরীরে ট্যাটু বা উল্কি করেছিল। সে যুগের উল্কিই এখনকার ট্যাটু।
শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় ৩৩০ বছর আগে ১৬৯১ সাল নাগাদ উইলিয়াম ডাম্পিয়ার নামে এক পরিব্রাজকের হাত ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্যাটু ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রায় ১৭০-১৭২ বছর পর ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ মেজর জেনারেল হোরাশিও গর্ডন রবলে (Horatio Gordon Robley) কর্মসূত্রে নিউজিল্যান্ডে যান। সে সময় নিউজিল্যান্ড ছিল ব্রিটিশদের একটি উপনিবেশ। যে কয়েক বছর মেজর জেনারেল রবলে সেখানে ছিলেন তার মধ্যে একটা বিষয় তাঁকে খুব অবাক এবং একইসঙ্গে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর নজর কেড়েছিল নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতিদের মুখ ও শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নিখুঁত এবং বিচিত্র আঁকিবুকির উল্কি বা ট্যাটু।
এই মাওরি উপজাতি নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায় আজও বসবাস করেন। এই উপজাতির মানুষেরা তাঁদের ধর্মবিশ্বাস বা সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী নিজেদের বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করার জন্য গোটা শরীর আর মুখজুড়ে উল্কি বা ট্যাটু করেন। শরীরের নানা অংশে অথবা শরীরজুড়ে উল্কি বা ট্যাটু অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু মাওরি উপজাতির মানুষদের মতো এমন মুখজুড়ে উল্কি বা ট্যাটু এখনও খুব একটা চোখে পড়বে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে মাওরি উপজাতির মানুষদের মুখময় উল্কির বৈচিত্র খুব অবাক ও আকৃষ্ট করেছিল ওই ব্রিটিশ মেজর জেনারেলকেও।
মাওরি উপজাতির মানুষদের শরীর আর মুখজুড়ে আঁকা উল্কি ‘টা মোকো’ নামে পরিচিত। এই ‘টা মোকো’ জেনারেল রবলেকে (Horatio Gordon Robley) এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, তিনি উল্কি ভরা মাওরিদের ডেকে ডেকে তাদের ছবি আঁকতে শুরু করেন তিনি। নিজের নোট বইতে মাওরিদের ছবি এঁকে তা নিয়ে লেখালেখি শুরু করে দেন জেনারেল রবলে। কিন্তু হাতে আঁকা ছবি দিয়ে তিনি কী করে সকলকে বোঝাবেন যে, কত অদ্ভুত এবং বৈচিত্রময় মাওরিদের মুখজুড়ে থাকা উল্কি বা ট্যাটুগুলি!
মাওরিদের উল্কি বা ট্যাটুগুলি সম্পর্কে পরিষ্কার করে সবাইকে বোঝাতেই পারছিলেন না ব্রিটিশ মেজর জেনারেল হোরাশিও গর্ডন রবলে (Horatio Gordon Robley)। পাতার পর পাতা বিরবণেও বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছিল না। তাই কিছু একটা বিকল্প উপায় খুঁজতে শুরু করেন তিনি। শেষে এক অদ্ভুত উপায় তাঁর মাথায় আসে। জেনারেল রবলে (Horatio Gordon Robley) মৃত মাওরিদের উল্কি করা মাথা কেটে নিজের কাছে সংগ্রহ করে রাখবেন বলে ঠিক করেন। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ! এর পর থেকেই মৃত মাওরিদের কাটা মাথা সংগ্রহ করে সেগুলিকে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করা শুরু করেন মেজর জেনারেল হোরাশিও গর্ডন রবলে (Horatio Gordon Robley)। তাঁর সংগৃহীত ‘টা মোকো’-এ ভরা মৃত মাওরিদের কাটা মাথাগুলিকেই বলা হয় ‘মোকোমোকাই’।
কিন্তু সে কালে নিউজিল্যান্ডের জঙ্গলে ঘেরা এলাকায় মানুষের কাটা মাথা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন মেজর জেনারেল হোরাশিও গর্ডন রবলে (Horatio Gordon Robley)? যত দূর জানা যায়, মাথার ভেতরের পচনশীল অংশগুলিকে (যেমন, ঘিলু, চোখ ইত্যাদি) বের করে এনে তার মধ্যে এক ধরনের গাছের ছাল আর বিশেষ এক ধরনের আঠা ভরে দিয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হতো। মুখের উপরের চামড়াতেও মাখিয়ে দেওয়া হতো বিশেষ ওই আঠা। এই ভাবে সংরক্ষণের ফলে প্রায় দেড়শো বছর পেরিয়েও প্রায় অবিকৃত থেকে গিয়েছে এই মোকোমোকাই।
অবসরের পর যখন ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন মেজর জেনারেল গর্ডন রবলে, তখন তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রায় ৩৫-৪০টি মৃত মাওরিদের কাটা মাথা বা মোকোমোকাই। কিন্তু তাঁর সংগ্রহের অধিকাংশ মোকোমোকাই উপযুক্ত সংরক্ষণ, জায়গার অভাব আর অযত্নে নষ্ট হয়ে যায়। মেজর জেনারেল হোরাশিও গর্ডন রবলের (Horatio Gordon Robley) সংগ্রহের মোকোমোকাইয়ের কয়েকটি আজও ‘আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’তে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে।