প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। মৃণাল সেনের মৃগয়া ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জেরে জাতীয় পুরস্কার এসেছিল অনায়াসে। কিন্তু বলিউডে জাতীয় পুরস্কারের মূল্য কতটা তা টের পেয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। তখনও মৃগয়া মুক্তি পায়নি। রোজ বিভিন্ন প্রযোজকের অফিসে কাজের জন্য হত্যে দিচ্ছেন মিঠুন। হাতে তাঁর একটি পোর্টফোলিও। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার লড়াই চালাতে গিয়ে তখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
তেমনই একদিন এক প্রযোজকের অফিসে গিয়েছেন কাজের জন্য। পোর্টফোলিও জমা দিতে। সে সময় অফিসে উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা জীতেন্দ্র। মিঠুনকে দেখে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, 'যদি এই ছেলে কোনও দিন নায়ক হতে পারে, তবে আমি অভিনয় ছেড়ে দেব।' মিঠুন সেই মন্তব্যের কোনও প্রতিবাদ করতে পারেননি। কী ভাবেই বা করতেন। সদ্য কাজ পা রেখেছেন সিনেমায়। কেউ তাঁকে চেনেন না। নেই কোনও গডফাদার। বলিউডে যাঁদের এমন অবস্থা থাকে তাঁদের মুখ বুজে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। মিঠুনও করেছিলেন। তবে এই মন্তব্যে ভেঙে পড়েননি। জেদ আরও বেড়ে গিয়েছিল।
একই ভাবে ১৯৮০ সালে গলিয়োঁ কে বাদশা ছবিতে ছোট এটি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মিঠুন। সেই ছবিতে প্রধান চরিত্রে ছিলেন রাজকুমার এবং হেম মালিনি। মিঠুন-কে ছবিতে নেওযা হয়েছে জানতে পেরে রাজকুমার পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করেন যাতে মিঠুনকে ছবি থেকে বাদ দিয়ে অন্য কোনও পরিচিত মুখতে নেওয়া হয়। মিঠুন সে দিন সামনে এসে রাজকুমারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাজকুমার ভীষণ অপমান করেন মিঠুনকে। বলেন অভিনয় করা যার তার কম্ম নয়। মিঠুন অত্যন্ত সংযত ভাবে তার উত্তরে বলেছিলেন, তিনি এমন আচরণ করলে কোনও জুনিয়র অভিনেতা তাঁর সঙ্গে অভিনয় করতে চাইবেন না। এটাও জানিয়ে গিয়েছিলেন, একদিন রাজকুমারের মতো বড় স্টার হবেন মিঠুন। সে কথা সে দিন হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজকুমার।
এ বার ১৯৮৬ সালে একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করা যাক। সেই বছর জিতেন্দ্র-র সঙ্গে তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মিঠুন। অ্যায়সা পেয়ার কাহাঁ, জাল এবং স্বর্গ সে সুন্দর। বলাই বাহুল্য, সে সময় ধারে ভারে এবং স্টার পাওয়ারে জিতেন্দ্রর চেয়ে মিঠুনের পাল্লা অনেক ভারী ছিল। একই ভাবে আরও তিন বছর এগিয়ে যাওয়া যাক। গলিয়োঁ কে বাদশা ছবির কাজ কোনও কারণে বন্ধ হয়ে যায় এবং ছবিটির মুক্তি পিছিয়ে যায় ৯ বছর। ১৯৮৯ সালে তখন রাজকুমারের জমানা শেষ হয়ে গিয়েছে। মিঠুন তখন মধ্য গগনে। রাজকুমারের সিনেমাটি তখন কিনতে কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ছবির প্রযোজক পরিচালক সিনেমায় ছোট্ট চরিত্রে থাকা মিঠুনের ছবি পোস্টারে বড় করে ছাপানোয় সিনেমাটি বিক্রি হয়। তবে তাতেও ফ্লপ হওয়া আটকানো যায়নি।
জীতেন্দ্র তৎকালীন সময়ে বলিউড নায়কদের মধ্যে একটু-আধটু নাচতে পারতেন। ফলে অভিনয়ের সঙ্গে সেটা ছিল তাঁর প্লাস পয়েন্ট। এই নাচ আর অভিনয়ের কম্বিনেশনে বেশ কয়েকটি ছবিও হিট করেছিল তাঁর। তবে মিঠুন যে নাচ প্রথমবার পর্দায় দর্শকদের দেখালেন, তার সঙ্গে জীতেন্দ্রের 'পিটি- নাচের' কোনও তুলনা ছিল না। কারও কাছে না শিখে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় ভারতের মাইকেল জ্যাকসনের তকমা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন মিঠুন। যদিও একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমি এলভিসের ফ্যান। ওকে ভীষণ ভাবে নকল করার চেষ্টা করি। মাইকেলকেও ভালো লাগে। ওঁদের নতুন কোনও গান মুক্তি পেলেই তার ভিডিও দেখার চেষ্টা করি।'
এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল মিঠুনের কষ্টার্জিত খ্যাতির সূচনা। বলিউডে টিকে থাকতে করেছেন স্পটবয়ের কাজও। রেখা এবং অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দো অনজানে-র সেটে তিনি রেখা এবং অমিতাভের স্পটবয় ছিলেন। ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। বাকি সময় এই দুই মহাতারকার ব্যাগ বয়েছেন। শপিংয়ে গিয়ে তাঁদের ঝুলি উঠিয়ে নিলেছেন কাঁধে। পরবর্তীকালে এই তারকাদের সঙ্গে এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ছোট্ট চরিত্র নয়, রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। ১৯৮২ সালের একটি ছবিই মিঠুনের ভাগ্য বদলে দেয়।
সে কথা অবশ্য সকলেরই জানা। ডিস্কো ডান্সার ছবির গান, গল্প আর মিঠুনের নাচ ছিল ভারতীয় দর্শকদের জন্য একেবারে নতুন জিনিস। একজন স্টেজ তারকা তাঁর মিউজিকাল জার্নি এবং এর মধ্যে প্রেম, প্রতিশোধের ককটেল পাঞ্চে নক আউট হয়ে গিয়েছেন আপামর দর্শককুল। সেই পাঞ্চেই মিঠুন হয়েছিলেন বলিউডের নতুন সুপারস্টার এবং সমালোচকরা স্ক্রিন থেকেই প্রায় মুছে গিয়েছিলেন।