কেউ বলেন মা সরস্বতী স্বয়ং তাঁর কণ্ঠে অধিষ্ঠান করেন। কেউ তাঁকে বলেন সুর সম্রাজ্ঞী। এমন কোনও গান নেই যা তাঁর কণ্ঠে অতুলনীয় হয়ে ওঠেনি। তিনি লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar). আজ তাঁর ৯২তম জন্মদিনে আজতক বাংলার তরফ থেকে অসংখ্য শুভেচ্ছা এবং নিরোগ জীবনের প্রার্থনা রইল। তার সঙ্গে রইল লতা মঙ্গেশকরের কিছু অজানা বা অল্প জানা গল্প, যা সোনালি অতীতকে আরও একবার পুনরুজ্জীত করে তুলবে।
অনেকেই মনে করেন তখনকার শিল্পীদের মধ্যে ভালো গাইবার, আরও ভালো কাজ করা নিয়ে প্রতিযোগিতা বেশি থাকত। এখনও যে নেই তা নয়, তবে তখন একটা মূল্যবোধ এবং শিষ্টাচার এর সঙ্গে মিশে ছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর সম্মান ছিল বলেই তাঁরা আজও বরেণ্য শিল্পী হিসাবে মানুষের মনে চিরকালীন স্থান করে নিতে পেরেছেন। আর সেই সম্মান এবং শিষ্টাচারের মাত্রা কেমন ছিল তা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (Hemanta Mukhopadhyay) কন্যা রানু মুখোপাধ্যায়ের (Ranu Mukherjee) স্মৃতিচারণ পড়লেই বেশ বোঝা যায়। রানু লিখছেন,
'আমার মা বেলা মুখোপাধ্যায় (Bela Mukhopadhyay) তখন মুম্বইতে, বাবার কাজের জন্য ওখানেই ওদের থাকা। মা তখন অন্তঃসত্ত্বা। মা-র এক মরাঠি বান্ধবী ছিলেন। এক সঙ্গে সিনেমা,শপিং, সবই চলত। বাবা তো গান পাগল মানুষ, মা-র একলা থাকা দূর হতো এ ভাবেই। তো সেই মরাঠি বান্ধবী একদিন মা কে বললেন, “বাঙালিদের এই সময় যেমন খাওয়ানোর রীতি থাকে তেমনই মরাঠিদেরও আছে।” এই বলে তিনি এক বিলাসবহুল হোটেলে মাকে খাওয়ালেন। বলা যায় সাধ খাওয়ালেন। মা পরে সেই বান্ধবীর আন্তরিকতার কথা আমাদের যে কতবার বলেছে। এমনকী স্মৃতিকথাতেও মা লিখেছেন ওই ঘটনার কথা! লেখার মতোই তো! সেই বান্ধবী যে স্বয়ং সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর! দুই পরিবারের কী সাংঘাতিক গানের, প্রাণের সম্পর্ক। কতবার ওঁর বাড়ি গিয়েছি। উনি এসেছেন! আমার জীবনের পরম পাওয়া লতা মঙ্গেশকরকে এত কাছ থেকে দেখা, ওঁর স্নেহ পাওয়া।'
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তিনি কতটা শ্রদ্ধা করতেন তার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। যার মধ্যে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। যার উল্লেখ হেমন্ত তাঁর আত্মজীবনী আনন্দধারায় করে গিয়েছেন। সেখানে লিখেছেন,
'আনন্দমঠ’ ছবির কাজ শুরু হল। ‘বন্দে মাতরম’ গানের সুর করতে হবে। গান কে গাইবে? লতাকে দিয়ে গাওয়াতে হবে। কথাটা বললাম শশধর মুখোপাধ্যায়কে। তিনি বললেন, লতা ফিল্মিস্থানে আসবে না। ও অনেক ব্যাপার। এদিকে সি রামচন্দ্রও ফিল্মিস্থান ছেড়ে দিয়েছেন। তুমি অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াও। মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। এ গান লতাকে দিয়ে না গাওয়াতে পারলে তো সব মাটি। একে আমি নতুন, তার ওপর লতা ছাড়া আর আর কাউকে দিয়ে গাওয়ালে কী দাঁড়াবে কে জানে! মনে মনে একটা প্ল্যান ঠিক করে ফেললাম। প্ল্যান ঠিক করার পর আবার ধরলাম মি. মুখোপাধ্যায়কে। বললাম, আপনি বলছেন লতা আসবে না! কিন্তু আমি যদি ওকে আনতে পারি তাহলে আপনাদের কোনও আপত্তি আছে কি?
উনি শুনে বললেন, না, আমাদের তরফ থেকে কোনও আপত্তি নেই। বরং ও এলে ভালোই হয়। কিন্তু আমি তোমায় বলছি, ও আসবে না। সব ব্যাপারেই আমি নিজে এগিয়ে গেছি। অতএব এ-ব্যাপারেও আমি কারোর সাহায্য ছাড়াই এগোলাম। একদিন গিয়ে দেখা করলাম লতার সঙ্গে।
তখন লতা ‘নানাচকে’ একটা একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। সোজা চলে গেলাম লতার কাছে। খুব আদর-আপ্যায়ন করল। ছোট্ট এইটুকু একটা মেয়ে, কী অসাধারণ নাম করেছে! মুগ্ধ হলাম। আরও মুগ্ধ হলাম ওর ব্যবহারে। প্রথম আলাপেই খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম। তারপর আমার প্রস্তাব পেশ করলাম।
লতা শুনে বলল, যদিও ফিল্মিস্থানের সঙ্গে আমার ঝগড়া, আমি ওখানে গাইব না ঠিক করেছি, কিন্তু শুধু আপনার জন্যেই গাইব।
জিজ্ঞাসা করলাম কত টাকা বলব?
ও বলল, শুধু আপনার জন্যে গাইছি। পয়সার জন্যে নয়। সুতরাং ফিল্মিস্থানের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও কথা বলার দরকার নেই। তারপর রিহার্সাল শুরু হল ‘বন্দে মাতরম’ গানের। লতা আমার বাড়িতে এসে রিহার্সাল দিল তিনদিন। যা ও সচরাচর করে না। ‘বন্দে মাতরম’ গানের যেদিন টেক সেদিন আবার আমার দুশ্চিন্তা শুরু হল। গান তো পছন্দ হয়েছে কিন্তু এবার মি. মুখোপাধ্যায়কে টেক পছন্দ করাতে পারলেই কাজ হাসিল।
এবার বাদ সাধলেন হেমেনদা। ছবির পরিচালক হেমেন গুপ্ত। অতএব ওঁর মতামতই চূড়ান্ত। গান টেক হচ্ছে। খুব ভালো গাইছে লতা। খুব দরদ দিয়ে গাইছে। গেয়ে খুশিও হচ্ছে লতা। কিন্তু একটুও খুশি হচ্ছেন না হেমেনদা। প্রতিটি টেক হচ্ছে আর উনি বিরক্ত হয়ে বলছেন, প্রাণ পাচ্ছি না।
লতা নিজের গান নিজেই যাচাই করে ভালোমন্দ রায় দেয়। মিউজিক ডিরেক্টররা লতার গানের ব্যাপারে কোনও কথা বলেন না। ছবির পরিচালকরাও লতাকেই বিচারকের আসনে বসিয়ে ওর রায় শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকেন। আর সেই লতাকে কিনা নস্যাৎ করে দিচ্ছেন হেমেনদা! পর পর আটটা টেক হল, কিন্তু একটাও পছন্দ হল না পরিচালক হেমেন গুপ্তর।
আমি তো তখন অন্য আশঙ্কা করছি। এত সেধে লতাকে নিয়ে এলাম ফিল্মিস্থানে। হেমেনদার ব্যবহারে এখন যদি রেগেমেগে চলে যায়, তাহলে সব শ্রম পণ্ড। লতা খুব বুদ্ধিমতী। আমার অবস্থাটা বুঝল। বলল, দাদা তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার গান টেক করে আমি যাব। যতক্ষণ না ওঁর পছন্দ হয় আমি গান করে যাব। মনে আছে, সেদিন লতার গান পছন্দ করাতে কম করে কুড়ি, একুশটা টেক করতে হয়েছিল। আমার সুরে প্রথম রেকর্ড হল ফিল্মিস্থানে। আর লতার জীবনেও কুড়ি একুশটা টেক বোধহয় এই প্রথম!'
এখনকার দিনে কোনও শিল্পী বিনা পারিশ্রমিকে শুধুমাত্র শ্রদ্ধার জায়গা থেকে গায় রেকর্ড করছেন আর তার জন্য নিজের সমস্যাকে দূরে সরিয়ে একুশটা টেক দিচ্ছেন এ কথা বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। কিন্তু তিনি তো লতা মঙ্গেশকর। তাঁর সুরের জাদুতে মোহিত না হয়ে উপায়ও যে নেই!
কৃতজ্ঞতা: আনন্দবাজার পত্রিকা, আনন্দধারা