ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি অন্যতম একজন নক্ষত্র। বাংলায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আগে তিনি ছিলেন অন্যতম বাংলার বাঘ। পঙ্কজ রায়, ব্যাট হাতে পারদর্শী এই বাঙালি ২২ গজে মন কেড়েছেন একাধিক তাবর ক্রিকেট প্রেমী সহ ক্রিকেট মহলের মানুষ জনের। প্রায় ১০ বছর আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় ক্রিকেট খেলেছিলেন এই বাঙালি। লড়াইটা ছিলো একার সঙ্গে একার। এই ফুটবল প্রেমী বাঙালি কীভাবে হয়ে উঠলেন বিশ্বমানের ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের ৯৩তম জন্ম বার্ষিকীতে স্মৃতিচারণায় এবার তাঁর পুত্র প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার প্রণব রায়। একান্ত সাক্ষাৎকারে আজতক বাংলাকে বহু অজানা ক্রিকেট ইতিহাসের পাঠ শোনালেন বাংলার অন্যতম নক্ষত্র ক্রিকেটার প্রণব রায়। তাঁর অনুপস্থিতিতেও তাঁকে মনের মাঝে রেখেই কুর্নিশ জানায় ক্রিকেট অনুরাগীরা।
৩১ মে ১৯২৮ সালে জন্ম হয়েছিল প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের। তিনি যেমন ভালোবাসতেন কভার ড্রাইভ ও হুক করতে ঠিক তেমনই তাঁকে বহু লড়াই ও স্ট্রাগলের মধ্যেই খেলতে হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলে। এমন একজন ক্রিকেটার যে শুধু ভারতীয় ক্রিকেটে খেলাই নয় ১৯৮৩ সালের ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী কপিল দেবের দল বাছাইয়ের অন্যতম নির্বাচক ছিলেন পঙ্কজ রায়। পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক রেকর্ড তৈরি হয়েছিল এবং তাদের অনেকগুলি ভেঙেও গিয়েছে। ১৯৬৬ সালে, পঙ্কজ রায় এবং বীণু মানকাড়ের ওপেনিং জুটিও একটি বিশেষ রেকর্ড তৈরি করেছিল। চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে উভয়েরই ৪১৩ রানের উদ্বোধনী জুটি ছিল, যা এখনও মানুষের মনে। পঙ্কজ রায়ের ১৭৩ রান এবং বিনু মানকড়ের ২৩১ রানের ইনিংস।
তবে এই রেকর্ডের পিছনের কাহিনী অনেকেরই জানা নেই। এই বিষয় নিয়ে প্রণব রায় বললেন, ''নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ ছিলো। বাবা (পঙ্কজ রায়) ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিল তার আগে। তবে কলকাতায় একটি ম্যাচ থাকায় বাবাকে ফের দলে নেওয়া হয়। আর সেই ম্যাচে বাবার কামব্যাক ঘটেছিল সেঞ্চুরি দিয়ে। তারপর চেন্নাইয়ে এই নিউজিল্যান্ড সফরেই দুরন্ত ইনিংস খেলেন। বিশ্বরেকর্ড এই ইনিংস।''
তবে এই ইনিংস খেললেও পঙ্কজ রায়ের একটাই আক্ষেপ ছিলো টেস্টে ডবল সেঞ্চুরি মিস করা। এই ম্যাচে এই ইনিংসেই ডবল সেঞ্চুরির দিকে এগোচ্ছিলেন পঙ্কজ রায়। তবে সেখানে ঘটেছিল আরও একটি অন্য ঘটনা। সেই নিয়ে প্রণব রায় বললেন, ''বাবা বলেছিল একটাই আক্ষেপ দ্বিশতরান তিনি করতে পারেননি। শুনেছিলাম বাবার কাছে ড্রিনকসের সময় একটা উড়ো খবর এসেছিল যে ভারত ইনিংস ডিক্লিয়ার করবে তোমরা মেরে খেলো। তো সে সময় বাবা চালিয়ে খেলতে যায় ও ১৭৩ রানে আউট হন। তবে তারপর জানা যায় যে ভারতীয় দল সেই ইনিংস ঘোষণা করেনি ও এমন কোনও খবর যায়নি। তাই হয়তো দ্বিশতরানটা মিস করে গিয়েছেন।'
কেরিয়ারের শুরুর দিকে পঙ্কজ রায় ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। খেলেছেন তাবর দল ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহমেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় আইএফএ-র দলেও ফুটবল খেলেছিলেন এই ক্রিকেটার। বেশ কিছু বছর ফুটবল খেলার পর মহমেডানের বিরুদ্ধে একটি ফুটবল ম্যাচে চোট পেয়েছিলেন পঙ্কজ রায় আর সেখান থেকেই তাঁর ক্রিকেটার হিসাবে প্রত্যাবর্তন। এই বিষয় নিয়ে পুত্র প্রণব রায় বলছিলেন, ''বাবা দারুণ ফুটবল খেলতেন। স্পোর্টিং ইউনিয়ানের হয়ে ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছেন। বড় দলের বিরুদ্ধে খেলেছেন। তবে চোট পেয়ে আর খেলা হয়নি। তখন বন্ধুরা বলেছিল ক্রিকেটটাও তুই ভালো খেলিস। তখন থেকেই ক্রিকেট শুরু হয়।''
পঙ্কজ রায়ের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার - প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের সময় পঙ্কজ রায় ১৯৪৬ সালে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ঘরের মাঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরে ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। অভিষেক টেস্ট সিরিজে, পঙ্কজ রায় দুটি সেঞ্চুরি সহ ৩৮৭ রান করেছিলেন। ৯৯৫৫-৫৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স করেন এই ক্রিকেটার। আজকের দিনে বেঁচে থাকলে হয়ো বিরাট কোহলি- রোহিত শর্মাদের দেখে খুব খুশি হতেন পঙ্কজ রায় এমনটাই জানালেন পুত্র। ছেলে প্রণব রায় বলছিলেন, ''আজকের দিনে বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। ক্রিকেটটা এতটা এগিয়ে গিয়েছে ভাবা যায় না। তখন ভারি ব্যাট ও অন্য ধরনের ব্যাটে খেলা হতো এখন পুরো বদলে গিয়েছে। রোহিতের হুক, বিরাটের কভার ড্রাইভ পছন্দ করতেন অবশ্যই। কারণ বাবাও এই দুটো শট খুব ভালোবাসতো।''
প্রণব রায় আরও বলেন, ''শুধু বিরাট ও রোহিত নয়। বাবা বেঁচে থাকার সময় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, শচীনের খেলাও দেখতেন। নিজের পরবর্তি প্রজন্মকে এত ভালো ক্রিকেট খেলতে দেখে দারুণ প্রশংসা করতেন ও ক্রিকেটের প্রতি গর্ববোধ করতেন।''
পঙ্কজ রায় শুধু ক্রিকেট খেলাই নয়, বাকিদের উপদেশও দিতেন ভালো খেলার জন্য। তাঁর ছেলে প্রণব রায়কেও অনেক কিছুতে সাহায্য করেছেন। আবার রেগেও যেতেন খারাপ পারফরম্যান্স করলে। সেই নিয়ে প্রণব বাবু বলছিলেন, ''কীভাবে বড় ম্যাচে খেলবো। কীভাবে ছোট ইনিংসকে বড় করব সেই সব উপদেশ, পরামর্শ দিতেন বাবা। আবার আমার খারাপ পারফরম্যান্সে খুব বকাও দিতেন। একটি ফার্স্টক্লাস ম্যাচে খারাপ পারফর্ম করেছিলাম, সারাদিন বকা দিয়েছিলেন।''
পঙ্কজ রায় তার টেস্ট ক্যারিয়ারে মোট ১৪ বার আউট হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি একটি টেস্টে ভারতের অধিনায়কও ছিলেন। তবে সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছিল ভারত। পঙ্কজ রায় তার কেরিয়ারে ৪৩ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন, যেখানে তিনি ৩২.৫6 গড়ে ২৪৪২ রান করেছিলেন। এই সময়, তার ব্যাট থেকে ৯টি হাফ-সেঞ্চুরি এবং ৫ টি সেঞ্চুরি এসেছিল। তিনি ১৮৫ টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে ৪২.৩৮ গড়ে ৪৩ টি সেঞ্চুরি এবং ৫০ টি হাফ-সেঞ্চুরি সহ ১১৮৬৮ রান করেছিলেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ২০২।
পঙ্কজ রায় অবসরের পর নির্বাচক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপের জন্য ভারতীয় দলকে নির্বাচন কমিটিরও একজন ছিলেন। পঙ্কজ রায় ২০০০ সালে কলকাতার শেরিফ নিযুক্ত হন। ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী দিয়েও ভূষিত করেছিলেন। ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল এই তারকা ক্রিকেটারের।
তিনি অনেকদিন এই পৃথ্বী ছেড়ে চলে গেলেও, এখনকার ক্রিকেটারদের জন্য অন্যতম অনুপ্রেরণা এই বাঙালি। পুরনো সেই দিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বহু বাধার সামনে পরেও হার না মানা এই বাঙালিকে এখনও পর্যন্ত কুর্নিশ জানায় ক্রিকেট মহল। জানা-অজানার মাঝে ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে সব সময় ওপরের দিকেই থাকবেন পঙ্কজ রায়।