
২০২০ সাল। ক্যালেন্ডারের একটা সাধারণ বছর হলেও এই বছরটা যে কতটা কলঙ্কিত, সেকথা আমরা সকলেই জানি। সৌজন্যে করোনা মহামারী। করোনা মহামারীর জেরে গোটা বিশ্বই কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত মার্চ মাস থেকে লকডাউনের জেরে কার্যত থেমে গিয়েছিল জনজীবন। এই মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি খেলার ময়দানও। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বহু টুর্নামেন্ট। এমনকী, স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল বহু লিগ। তেমনই একটি ফুটবল লিগ হল বাংলার কন্যাশ্রী কাপ। রাজ্য় সরকারের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই ফুটবল টুর্নামেন্ট করোনার জেরে বেশ কয়েকমাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে নিউ নরম্যাল পিরিয়ডে আবারও সেই টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে।
কন্যাশ্রী কাপ আবার শুরু হওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন রাজ্যের আদিবাসী মহিলা ফুটবলাররা। প্রসঙ্গত, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম এবং জঙ্গলমহলের মহিলা ফুটবলাররা অত্যন্ত অভাবের মধ্যে দিয়ে দিন কাটান। কেউ মাঠে চাষ করেন, কেউ করেন রাজমিস্ত্রির কাজ, কেউবা আবার বাজারে সবজি বিক্রি করেন। এই কন্যাশ্রী কাপের জন্যই তাঁরা নতুন করে দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে আপনাদের জানিয়ে রাখি, বিগত তিন বছর ধরে IFA মহিলা ফুটবল লিগ পরিচালনা করছে। এবারে সেই লিগটাই কন্যাশ্রী কাপের মোড়কে আয়োজন করা হচ্ছে। মহিলাদের এই লিগের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে ১১ লাখ টাকা। সেইসঙ্গে অংশগ্রহণকারী মহিলা ফুটবলারদের প্রত্যেকদিনের টিফিন, গাড়িভাড়া এবং কিটসের জন্য আলাদা টাকাও দেওয়া হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে, এর থেকে বেশি আর কীই বা চাহিদা থাকতে পারে মহিলা ফুটবলারদের। কিন্তু, করোনার সময় যখন এই ফুটবল লিগ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। জীবনে এগিয়ে চলার যে সামান্য রূপোলি রেখাটা দেখা যাচ্ছিল, সেটাই যেন ভবিষ্যতের অন্ধকারে কোথাও মিশে যাচ্ছিল। অবশেষে আবারও লিগ শুরু হওয়ায় এই মহিলারা যথেষ্ট আনন্দিত।
তবে এবারের কন্যাশ্রী কাপে সেরা আকর্ষণ হল ইস্টবেঙ্গল মহিলা ফুটবল ক্লাব। ইতিপূর্বে তারা বিদ্যুৎ স্পোর্টিং ক্লাবকে ১৮-০ গোলে পরাস্ত করেছিল। আমডাঙার মাঠে সেই ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। তারপর থেকে মহিলাদের লাল-হলুদ ব্রিগেড আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। এই দলে খেলছেন পাঁচজন আদিবাসী মহিলা ফুটবলার। তাঁরা হলেন, মোগলি সোরেন, মমতা সিং, মমতা হাঁসদা, তুলসী হেমব্রম এবং গুরুবারি মান্ডি। দলের ম্যানেজার ইন্দ্রানী সরকার জানালেন যে ওরা সকলেই খুব গরীব পরিবার থেকে উঠে এসেছে। তবে ফুটবলটাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। প্রত্যেকটা ম্যাচেই ওরা জয়ের লক্ষ্যে মাঠে নামে। খাবার বলতে পায় দু'বেলা দু'মুঠো ডাল-ভাত। গ্রামের বাড়িতে খালি পায়ে হাঁটার কারণে ওদের পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। কিন্তু, ম্যাচের আগের দিন গরম জলে পা ডুবিয়ে রেখে পরেরদিন অনায়াসেই মাঠে নামতে পারে।
অন্যদিকে বিগত ২০ বছর ধরে চুঁচুড়ায় ফুটবল কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন তাপস কুমার দে। তাঁর কথায়, এই রাজ্যে মহিলা ফুটবল নিয়ে আগে কখনও বিশেষ মাথা ঘামায়নি কেউ। কিন্তু, এই সেন্টার থেকে প্রচুর মহিলা ফুটবলার উঠে এসেছে। খেলেছে বাংলা দলের হলেও। কিন্তু এরপরেও এই কোচিং সেন্টারের নিজস্ব কোনও মাঠ নেই। মেয়েদের পোশাক পরিবর্তন করার জন্য একটা ঘরও বরাদ্দ হয় না। যেদিন যে মাঠে প্র্যাক্টিস করানো হয়, সেদিন সেই মাঠের ধারে থাকা কোনও বাড়িতে গিয়ে মেয়েরা তাদের পোশার পরিবর্তন করে! তাঁর মতে, এই কন্যশ্রী কাপ আগামীদিনে বাংলার মহিলা ফুটবলের এক নয়া রূপরেখা তৈরি করবে। সেইসঙ্গে এই গরীব মেয়েরাও হাতে কিছু টাকা পাবে।