Free IVF SSKM: স্বাস্থ্য পরিষেবায় নয়া নজির গড়ল SSKM। এই প্রথম কোনও সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে জন্মাল টেস্ট টিউব বেবি। শুধু রাজ্য না, দেশে এই প্রথম ফ্রি-তে টেস্ট টিউব বেবি জন্ম নিল, কোনও সরকারি হাসপাতালে। একসময় টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে কাজ করতে গিয়েই সরকারের হেনস্থার মুখে পড়েছিলেন বাংলার কৃতী ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পরে আত্মহনন করেছিলেন তিনি। আর আজ সেই বাংলারই সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ ফ্রি-তে জন্ম নিল টেস্ট টিউব বেবি।
ডাক্তার সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারের উদ্যোগ
বন্ধ্যাত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারের নেতৃত্বে তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে SSKM এই প্রকল্প চালাচ্ছে। তবে এই একজনই নয়, মোট ৩৬ জন দম্পতির কোল আলো করার লক্ষ্য স্থির করেছেন তাঁরা।
নিঃসন্তান, আর্থিকভাবে সাধারণ দম্পতিদের বিনা খরচে মা-বাবা হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
এমনিতে অনেক খরচ
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই মহিলা গত ৫-৬ বছর ধরে মা হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে IVF করতে লাখখানেক টাকার ব্যাপার। সেটা তাঁর সাধ্য়ে ছিল না। এমন সময়েই তাঁর পাশে দাঁড়ান সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার ও তাঁর টিমের চিকিৎসকরা। SSKM-এর উদ্যোগে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাঁকে মা হতে সাহায্য করা হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর গর্ভে ভ্রুণ স্থাপন করা হয়। গতকাল, শুক্রবার এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন তিনি। মা-মেয়ে দু'জনেই সুস্থ আছেন।
আরজি কর-চিকিৎসকদের আন্দোলনের আবহে, রাজ্য়ের স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে যে এটি একটু হলেও ইতিবাচক হাওয়া জোগাবে, তা বলাই যায়।
টেস্ট টিউব বেবি কী?
টেস্ট টিউব বেবি হল এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে মহিলার শরীরের বাইরে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুকে মিলিত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সেই ভ্রূণটি নারীর জরায়ুর মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়।
এর বৈজ্ঞানিক নাম ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF)।
এই পদ্ধতিতে মহিলার ডিম্বাণু (Egg) এবং পুরুষের শুক্রাণু (Sperm)কে শরীরের বাইরে, ল্যাবরেটরির বিশেষ টেস্ট টিউব বা পাত্রে একত্রে নিষিক্ত করা হয়। অর্থাৎ, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন প্রাকৃতিকভাবে না হয়ে শরীরের বাইরে ঘটে। এরপর ভ্রূণ তৈরি হলে সেটিকে মহিলার জরায়ুর (Uterus) মধ্যে স্থাপন করা হয়, যাতে সেখানে স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণের মতো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
টেস্ট টিউব বেবি ও ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়: এক করুণ ইতিহাস
১৯৭৮ সালে ব্রিটেনে IVF পদ্ধতিতে প্রথমবার এক শিশুর জন্ম হয়। তার নাম দেওয়া হয় লুইস ব্রাউন। ব্রিটেনের ওল্ডহামের রয়টনের ডাঃ কেরশোর কটেজ হাসপাতালে (বর্তমানে ডাঃ কেরশোর হসপিস) হয়েছিল। ফিজিওলজিস্ট রবার্ট জি. এডওয়ার্ডস এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে সহ-গবেষক ছিলেন। ২০১০ সালে ফিজিওলজি বা মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। তাঁর সহকর্মী ছিলেন প্যাট্রিক স্টেপটো এবং জিন পার্ডি।
এদিকে, ব্রিটেনে যখন সেখানকার ডাক্তাররা আধুনিক যন্ত্র ও প্রচুর ফান্ড নিয়ে কাজ করছেন, তখনই বাংলার এক কৃতী সন্তান নিজের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরনো যন্ত্রপাতি, নিজের আয়ের টাকা ও একটি সাধারণ খাবার রাখার ফ্রিজ ব্য়বহার করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ব্রিটেনে লুইস ব্রাউনের জন্মের মাত্র ৬৭ দিন পর ১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর ভারতের প্রথম ও বিশ্বের দ্বিতীয় 'টেস্ট টিউব বেবি'র জন্ম হয়। হাজারিবাগের চিকিত্সক ও গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায় সফল হন। কিন্তু, তৎকালীন রাজ্য সরকার তাঁকে সাহায্য তো করেইনি, বরং তাঁর গবেষণা রীতিমতো রুখে দেয়। কোনওরকম বৈজ্ঞানিক সম্মেলন বা গবেষণাপত্রে তাঁর কাজ প্রকাশ করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
একটি নয়, দুইটি পিএইচডি ছিল ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। তার মধ্য়ে একটি ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরার। চাইলে ব্রিটেনেই মোটা বেতন, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গবেষণা চালাতে পারতেন। কিন্তু সেই সব ছেড়ে তিনি বাংলা ও বাঙালির পাশে থাকতে ফিরে এসেছিলেন।
সেই সময়কার(১৯৭৮) পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার তাঁকে কোনওরকম স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তাঁকে চূড়ান্তভাবে অবহেলা, তিরস্কার এবং অপমান করা হয়। তাঁর দাবি 'মিথ্যা' বলা হয়। ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দাবি পরীক্ষা করার জন্য সরকার একজন রেডিওফিজিসিস্টের নেতৃত্বে একটি প্যানেল নিযুক্ত করেছিল। সেই কমিটির কর্তৃক চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে ১৯৮১ সালের ১৯ জুন কলকাতার বাসভবনে আত্মহত্যা করেন ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
আর আজ সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেই বিশ্বজুড়ে মানুষ চেনেন টেস্ট টিউব বেবি-র জনক হিসাবে। প্রত্যেক গাইনোকলজিস্ট তাঁর নাম জানেন।
১৯৭৮ সালে অক্টোবরে তাঁর হাত ধরেই পৃথিবীর আলো দেখেছিল দুর্গা। আর আজ ২০২৪ সালে, আরও এক পুজোর আগে তাঁরই দেখানো পথে বাংলায় এল আরও এক দুর্গা। সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে টেস্ট টিউব বেবির এই নজির যে আগামিদিনে বহু চিকিৎসককে অনুপ্রাণিত করবে, তা বলাই বাহুল্য।