মোদী মন্ত্রিসভার রদবদলে বাংলা ৪ মন্ত্রী পেয়েছে। যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চর্চায় রয়েছেন নিশীথ প্রামাণিক। সেইসঙ্গে বঙ্গের চার মন্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক কিন্তু পেয়েছেন নিশীথই। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ডেপুটি হয়েছেন তিনি। বলা যায় বাংলায় অমিত শাহের "চোখ-কান” হিসেবে কাজ করবেন কোচবিহারের সাংসদ। কিন্তু শপথ নেওয়ার পর থেকে একের পর এক বিতর্কে নিশীথ। শপথের দিনই প্রশ্ন উঠেছে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে। তিনি মাধ্যমিক পাস নাকি বিসিএ উত্তীর্ণ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একদা নিশীথের প্রাক্তন দল তৃণমূল। তবে কোচবিহারের বিজেপি সাংসদকে নিয়ে আরও বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে। নিশীথ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হতেই 'পূজার মেলা' নামের এক ফেসবুক পেজ ও 'দৈনিক গাইবান্ধা'র প্রতিবেদনে নিশীথকে শুভেচ্ছা জানান হয়। লেখা হয়, "বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি থানার হরিনাথপুরের কৃতি সন্তান নিশীথ প্রামাণিক মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।"
বাংলাদেশের ওই ফেসবুক পেজ ও প্রতিবেদশনের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়েছে নেটমাধ্যমে। তাতেই প্রশ্ন উঠেছে নিশীথ প্রামাণিক কি তাহলে এদেশের নয় বাংলাদেশের নাগরিক? এই নিয়ে সম্প্রতি অসম কংগ্রেসের সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ রিপুন বোরা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। ভারতে কম্পিউটার শিখতে এসে নিশীথ কি এদেশে থেকে গিয়েছিল তা তদন্ত করার আর্জি জানিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ। নিশীথের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও ইন্দ্রনীল সেনও। নিশীথ প্রামাণিকের নাগরিকত্ব বিতর্কে সংসদেও সরব হয়েছে তৃণমূল। এই নিয়ে নিশীথ এখনও মুখ না খুললেও তাঁর ঘনিষ্ঠরা কিন্তু দাবি করছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোচিবিহারেই।
নিশীথের ঘনিষ্ঠদের দাবি
নিশীথের বাবা বাংলাদেশি হলেও তিনি জন্মগত ভাবে ভারতীয়, এমনটাই দাবি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের। তার বাবার আদি বাড়ি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের ভেলাকোপা গ্রামে। স্বাধীনতার আগে এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন নিশীথের বাবা বিধূভূষন প্রামাণিক। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতে আসেন। এখানেই ১৯৮৬ সালে নিশীথ জন্ম। শিশু,কিশোর যুবক জীবনের সব পর্যায় এপারে কাটালেও বাংলাদেশের পলাশবাড়ীতে তিনি বহুবার গিয়েছেন। অর্থাৎ নিশীথের সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় যোগ অস্বীকার করা যায় না।
বাংলা থেকে ৪ সাংসদকে মন্ত্রী করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এঁদের মধ্যে নিশীথ ছাড়াও কিন্তু আরও দু'জনের পূর্ববঙ্গীয় যোগ রয়েছে। বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুরেরও বাংলাদেশি যোগ অস্বীকার করা যায় না। মতুয়া ধর্মের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মস্থান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি তাই বিশ্বের সমস্ত মতুয়াদের কাছে সবচেয়ে বড় তীর্থ। আর সেই হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরি হলেন শান্তনু ঠাকুর।
মোদী মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য হলেন বাঁকুড়া শহরেরই বাসিন্দা সুভাষ সরকার। পেশায় চিকিৎসক সুভাষবাবুর জন্ম বাঁকুড়াতে হলেও তাঁর বাবা কিন্তু এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকেই। বাঁকুড়ার মাচানতলা এলাকায় ফুটপাথে ছোট্ট একটি ছাতা মেরামতের দোকান করেছিলেন তিনি। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। তবে ছোট থেকেই মেধাবী সুভাষ সরকার টিউশন পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেই ডাক্তার হয়েছিলেন। অর্থাৎ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভায় বাংলা থেকে যাওয়া তিন মন্ত্রীর পূর্ববঙ্গীয় যোগ রয়েছে।
রাজ্যে সিএএ লাগু করা নিয়ে বরাবরই সুর চড়িয়ে এসেছে বিজেপি। মতুয়া ভোট ঝুলিতে পোড়ার অন্যতম কারণই হল সিএএ-লাগু করার প্রতিশ্রুতি। হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তুকে ভারতীয় মনে করে বিজেপি, নিশীথ প্রামাণিক বিতর্কের পর এমন মন্তব্যই করছেন গেরুয়া নেতৃত্ব। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর বক্তব্য, যদিও বা ধরে নেওয়া হয় যে নিশীথ বাংলাদেশের নাগরিক, তাহলেও তিনি তো হিন্দু উদ্বাস্তু। সেক্ষেত্রে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে সকল হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তুকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের গলাতেও একই সুর। উল্টে তথ্য প্রমাণ না দিয়ে কুৎসা রটানোর অভিযোগ তিনি তুলেছেন শাসক শিবিরের দিকে।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেই সারা দেশে সিএএ-এনআরসি চাইছে বিজেপি। কিন্তু এনআরসি-সিএএ নিয়ে দেশজুড়ে কম প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়নি গেরুয়া শিবিরকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজ্যে কোনওভাবেই সিএএ তিনি লাগু হতে দেবেন না। সিএএ লাগু হলে তাদের ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা অনেকেই। বাংলার মত অসমেও বহু হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তু রয়েছেন। রাজ্য থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠানো সম্ভব নয় একথা আগেই জানিয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি আগেই বলেছেন হিন্দু বাঙালিদের আশ্রয় দেওয়ার মতো ক্ষমতা আসাম সরকারের রয়েছে। তাঁদের তাড়ানো সম্ভব নয়। নিজের মন্ত্রীসভায় পূর্ববঙ্গের যোগ থাকা তিন বাঙালি মন্ত্রীকে জায়গা দিয়ে সেই বার্তাই যেন পরোক্ষে এই রাজ্যের মানুষকে সুচারু ভাবে দিয়ে রাখলেন মোদী-শাহ জুটি। সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাঙালি হিন্দুদের যেন স্বস্তি দিতে চাইল গেরুয়া থিঙ্কট্যাঙ্ক।