সালটা ২০১৪, পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিল গেরুয়া বাহিনী। আর তাতে বাবুল সুপ্রিয়র নাম দেখে চমকে উঠেছিলেন অনেকেই। ২০০০ সালে রিলিজ করেছিল বলিউড ব্লকবাস্টার 'কহো না প্যার হ্যায়।' আত্মপ্রকাশ করেছিলেন হৃত্বিক রোশন। সেই সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল আরও একজনের কেরিয়ারও। বাবুলের কন্ঠে আর হৃত্বিকের লিপে সেই সময় ঝড় তুলেছিল ' ‘দিল নে দিল কো পুকারা।' তারপর প্লে-ব্যাক গায়ক হিসাবে আর ফিরে তাকাতে হয়নি সুনীলচন্দ্র বড়াল ও সুমিত্রা বড়ালের সন্তানকে। ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে একসময় গায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বারিয়েছিলেন তিনি। ঠিক সেরকমি ২০১৪ সাল বদলে দিয়েছিল তাঁর কেরিয়ারের গতিপথ। শোনা যায় অটলবিহারী বাজপেয়ী ও নরেন্দ্র মোদীর গুণমুগ্ধ রামদেব বাবুলকে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে বাবুল রাজি হয়ে যান। বাকিটা ইতিহাস। সেবার রাজ্যে ২টি আসন পেয়েছিল গেরুয়া শিবির। আসানসোল থেকে বিপুল ব্যবধানে জেতেন বাবুল। জায়গা পান নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায়। তাঁকে নগরোন্নয়ন, নিবাস এবং নগর দারিদ্র দূরীকরণ মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হয়। পরে তা পরিবর্তন করে ভারী শিল্প মন্ত্রকের এমওএস করা হয়।
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার কেন্দ্র ক্ষমতায় ফেরেন নরেন্দ্র মোদী। জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন বাবুলও। অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা মুনমুন সেনকে বিপুল ভোটে হারিয়ে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্র থেকে পুনর্নিবাচিত হন। জয়ের ব্যবধান ছিল ১,৯৭,৬৩৭ ভোট। দ্বিতীয় মোদী মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পেয়েছিলেন বাবুল। কিন্তু গত বুধবার বদলে গিয়েছে গোটা চিত্র। সম্প্রসারিত মোদী মন্ত্রিসভায় বাংলা ৪ নতুন মন্ত্রী পেলেও মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে বাবুলকে। তারপর থেকে গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছে কেন তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হল। হঠাৎ করেই আসানসোলের সাংসদের প্রতি এই অনাস্থা কেন গেরুয়া শিবিরের? আর এসবের মাঝেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এবার বাবুল সুপ্রিয়র ভবিষ্যত কোন দিকে গড়াবে?
মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর থেকেই সোশ্য়াল মিডিয়াকে নিজের অস্ত্র হিসাবে যেন বেছে নিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। তার এক একটি ট্যুইট নতুন জল্পনার জন্ম দিচ্ছে। এতেই কোনও কোনও মহলে জোর চর্চা চলছে বাবুল সুপ্রিয় রাজনীতি ছাড়তে পারেন। কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতি না হলেও বিজেপি ছাড়তে পারেন তিনি। মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফার পর তাঁকে সংগঠনের কাজে লাগানোর বার্তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু সাংগঠনিক রদবদলের আগে বাবুল সুপ্রিয় ও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সংঘাত প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ঝালমুড়ি'খেয়ে সেই সময় বিতর্কে জড়িয়েছিলেন বাবুল। এই নিয়ে খবরের শিরোনামে উঠে আসেন তিনি। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়। বাবুল তখন বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঝালমুড়ি খাওয়াটা কেবলই রাজনৈতিক সৌজন্য ছাড়া আর কিছু নয়। এদিকে বাবুলের মন্ত্রিত্ব হারানোর খবর পেয়েই সহানুভূতি দেখিয়েছেন মমতা। “এখন ওঁদের কাছে বাবুল খারাপ।" এমন প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন প্রকাশ্যে। এর মাঝেই ট্যুইটারে এবার মুকুল রায় ও তৃণমূল কংগ্রেসকে ফলো করা শুরু করেছেন বাবুল সুপ্রিয় এমন খবর রটে। ফলে আসানসোলের সাংসদকে নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। তাহলে কি এবার তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী?
বিজেপির অন্দরের খবর, টুকরো টুকরো নানা ঘটনা বাবুলের গদিচ্যুত হওয়ার পিছনে অনুঘটকের কাজ করেছে। এবারের বিধানসভা ভোটে বাবুলকে দাঁড় করিয়েছিল গেরুয়া শিবির। বিজেপি ক্ষমতায় এলে তিনিও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন এমনটাও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু বিধানসভা ভোটে টালিগঞ্জ থেকে তিনি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি ভোটে তৃণমূলের অরূপ বিশ্বাসের কাছে হেরেছেন। কলকাতার বুকে এই নিদারুণ পরাজয় বাবুলের মতো হজম করতে পারছেন না অমিত শাহরাও। ভোটের আগে কিছু নেতাকে পার্টিতে নেওয়ার প্রশ্নে প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়েছিলেন বাবুল। যা সরাসরি অমিত শাহের 'রাজনৈতিক লাইন'কে চ্যালেঞ্জ করা। দলের অন্দরের খবর, বাবুলের এ হেন 'ঔদ্ধত্য' ভালোভাবে নেননি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এর মাঝেই সম্প্রতি তাঁর নিজের লোকসভা এলাকায় বাবুলের নামে পোস্টার পড়েছে। ভোটের ফলাফলের পর থেকেই নাকি বাবুলকে দেখা যায়নি , এমন দাবি তুলে নিখোঁজ সাংসদের নামে পোস্টার পড়ে জামুড়িয়াতে। অর্থাৎ বাবুলের লোকসভা এলাকাতে তাঁকে নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। এর আগেও সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র নামে নিখোঁজ ডায়েরি করেছিল রানীগঞ্জের একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। রাজনৈতিক মহল বলছে, আসলে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের অঙ্ক কষেই মোদী রদবদল করেছেন মন্ত্রিসভার। তাই পারফরম্যান্সের কারণেই তরুণ মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ও বাদ গিয়েছেন তালিকা থেকে। শোনা যাচ্ছে সম্প্রতী রাজনীতির থেকে গানেই বেশি 'মন' দিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। আর এই আবহেই নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা জিইয়ে রেখেছেন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ।