আপাতদৃষ্টিতে ব্যাঙ খুবই নিরীহ একটি প্রাণি। ‘করে নাকো ফোঁসফাস মারে নাকো ঢুসঢাস’ প্রকৃতির। আমাদের দেশে বর্ষাকালে ব্যাঙদের বেশি দেখা মেলে। এদেশে সোনা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ ইত্যাদি প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। যা একেবারেই বিষধর নয়। তবে কিছু কিছু প্রজাতির ব্যাঙ ভয়ানক বিষধর। আমাদের দেশে এই বিষধর ব্যাঙগুলো পাওয়া না গেলেও দক্ষিণ এশিয়া, আমাজনের গহীন জঙ্গল, গুয়ানা আর দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে এমন বিষধর প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায় সহসাই। এসব ব্যাঙের স্পর্শেও মৃত্যু হতে পারে। বিষধর ব্যাঙের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এদের শরীরে থাকে উজ্জ্বল রঙ। তাই রঙিন ব্যাঙ দেখলেই বনের পশু পাখিরা সতর্ক হয়।
আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়ে সিনেমা তে এমন ঘটনা রয়েছে যেখানে তারা বাঁশের মতো চিকন পাইপে (ব্লো পাইপ) ফুঁ দিয়ে ছোট ছোট বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে শিকার করে। তীরগুলোর ডগায় মাখানো থাকে ভয়ানক বিষ। এই বিষের একটা বড় যোগান আসে এইসব আসে বিষধর ব্যাঙ থেকে। এর জন্য অবশ্য ব্যাঙটিকে মারতে হয় না। কেবল সেই বিষধর ব্যাঙের পিঠে তীরের মাথাটা ঘষে নিলেই হয়।
যেদিন থেকে এই বিষের কথা জানা যায়, এই ব্যাঙগুলোর নতুন করে নামকরণ করা হয় Poison Dart Frog বা Poison Arrow Frog। বিজ্ঞানীরা খোঁজ-খবর করে জেনেছেন, ১৭৫ প্রজাতির বিষধর ব্যাঙ রয়েছে আমাদের পৃথিবীতে। চলুন তেমন বিষধর কয়েকটি ব্যাঙের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
হলুদ ডুরে ব্যাঙ (Yellow banded poison dart frog):
দক্ষিণ আমেরিকা, ভেনেজুয়েলা, গুয়ানা, ব্রাজিল, পূর্ব কলাম্বিয়ার কিছু এলাকায় এই ব্যাঙ দেখা যায়। হলুদের মাঝে কালো ডুরে চেহারার এই ব্যাঙগুলো বৃষ্টিবহুল এলাকায় বেশি দেখা যায়। ব্যাঙেরা সাধারণত পুরো শীতকালটা শীতঘুমে (হাইবারনেশন) কাটিয়ে দেয়। কিন্তু হলুদ ডুরে ব্যাঙের বেলায় ঘটনাটা পুরোই উল্টো। এরাই একমাত্র ব্যাঙ, যারা গ্রীষ্মকালে হাইবারনেশনে যায়। তাই তাদের হাইবারনেশনকে শীতনিদ্রা না বলে গ্রীষ্মনিদ্রা বলা যায় অনায়াসেই।
নীলাম্বরী ব্যাঙ (Blue poison arrow frog):
এই ব্যাঙও দেখতে শুনতে বেশ ছোটখাটই হয়। সর্বোচ্চ ৩/৪ সে.মি.। দেহের রঙ নীল আর তার মাঝে কালো ফোঁটা দেওয়া। ব্রাজিলের প্রায় সবখানেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানরা এর নাম দিয়েছে Okopipi। এই ব্যাঙের রঙ ছাড়াও আর যে জিনিসটি সহজেই চোখে পড়ে, সেটি হলো কুঁজ। এক মাত্র Blue poison arrow frog-এরই কুঁজ থাকে। আর সব বিষধর ব্যাঙের মতোই এরও খাদ্যাভাস একই। পিঁপড়া, মাকড়সা, শুঁয়োপোকা এসবই এর খাদ্য।
সবুজ ও কালো রঙের ব্যাঙ (Green and black poison dart frog) :
জলের কাছাকাছি থাকতেই বেশি পছন্দ করে এরা। সোয়া ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই বিষধর ব্যাঙগুলো বাঁচে ৭ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। একটু যাযাবর স্বভাবের এই ব্যাঙগুলো নিকারাগুয়া, পানামা, কোস্টারিকার ছোট ছোট সব জলাশয়েই দেখা যায়। তবে একটু বড় হলেই তারা চলে যায় সব হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। সবুজ-কালো রঙা এই ব্যাঙগুলোর দৃষ্টিশক্তি এবং ঘ্রাণশক্তি খুবই ভালো। সেজন্য মানুষের চোখেও এরা ধরা পড়ে কম। একটু নড়াচড়ার আভাস পেলেই বেমালুম গায়েব হয়ে যায় চোখের পলকে।
স্ট্রবেরি ব্যাঙ (Strawberry poison dart frog) :
নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা ও পানামার চারপাশে গেলেই লাল লাল একটি ব্যাঙ দেখা যায়, যায় যার নাম স্ট্রবেরি ব্যাঙ। স্ট্রবেরি ব্যাঙের পরিচিতির মূল কারণ হচ্ছে এর শরীরের রঙ। একটি প্রজাতিতেই ১৫ থেকে ৩০ ধরনের রঙ থাকতে পারে। তবে স্ট্রবেরি রঙের প্রাধান্য বেশি বলে এই নামটাই ওদের জন্য পাকা হয়ে গেছে।
বলিভিয়ান ব্যাঙ (Phantasmal poison frog) :
গাঢ় বাদামী আর হলুদের চওড়া ডোরাকাটা এই ব্যাঙগুলো বলিভিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে দেখা যায়। এ প্রজাতির ব্যাঙের বিষও যথেষ্ট শক্তিশালী। সম্প্রতি চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। কারণ বলিভিয়ান ব্যাঙের বিষ থেকে যে ব্যথা নিরোধক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা মরফিন থেকেও ২০০ গুণ বেশি কার্যকরী। এই ব্যাঙগুলোর বাহারি সুন্দর রঙের আড়ালে রয়েছে তাদের ভয়ংকর রূপ। এদের যে কেউ তাদের একটি মাত্র স্পর্শের মাধ্যমে অনেক বড় বড় প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে চোখের নিমেষেই।
অন্য সব ব্যাঙের মতো এইসব বিষধর ব্যাঙেদের খাদ্যাভাসও এক। পিঁপড়া, মাকড়সা, শুঁয়োপোকা এসবই এদের খাদ্য।
তবে এদের বিষ ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ অথবা ২০,০০০ ইঁদুরকে মারতে সক্ষম। সেই কারণে আন্তর্জাতিক চোরাবাজারে এই প্রজাতির একটি ব্যাঙের দাম দু'হাজার ডলার, যা প্রায় ১.৫০ লক্ষ টাকা।