বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লিখিত হয় চেরনোবিল বিপর্যয় (Chernobyl Disaster)। যা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির থেকেও কয়েক'শ গুণ ভয়াবহ বলে বিবেচিত হয়। চেরনোবিল বিপর্যয় কেন বা কী করে ঘটল অর্থাৎ দুর্ঘটনার আসল কারণ নিয়েও জল্পনা প্রচুর। ১৯৮৬-তে ঘটে যাওয়া চেরনোবিল বিপর্যয়ের ঘটনা আজও পারমাণবিক দুর্ঘটনার ভয়াবহতার নিদর্শন হয়ে রয়েছে।
চেরনোবিল কোথায় অবস্থিত?
বর্তমানে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইউক্রেন (Ukraine)-বেলারুশ (Belarus) সীমান্তে অবস্থিত। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৬শে এপ্রিল, ১৯৮৬-তে পারমাণবিক দুর্ঘটনাটি ঘটে, যা চেরনোবিল বিপর্যয় হিসেবে পরিচিত।
চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ভয়াবহতা
চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লির সংখ্যা ছিল ৪টি। দুর্ঘটনার সূত্রপাত চতুর্থ চুল্লিটিকে কেন্দ্র করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ হল সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয় ব্যবহার করে সস্তায় বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য অন্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হয়। কিন্তু যদি পারমাণবিক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যায়, তবে কী ঘটতে পারে? এই নিয়েই চলছিল পরীক্ষা নিরীক্ষা। দুর্ঘটনার দিন নিরাপদ শীতলীকরণের ওপর একটি পরীক্ষা চালানো হচ্ছিল। রাতে বিদ্যুৎকর্মীরা ভুল করে পারমাণবিক চুল্লিটির টার্বাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতল জল প্রবাহিত করে। ফলে সেখানে বাষ্প কম উৎপাদিত হয়। এতে পারমাণবিক চুল্লিটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু ঘটনাটি কি শুধুই তাই?
কিন্তু এও জানা যায়, সেদিন যে পরীক্ষাটি চালানো হচ্ছিল তা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার আগেই করা উচিত, তবে তারা এই পরীক্ষা না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য সবুজ সঙ্কেত দেয়। পর পর তিনবার পরীক্ষা চালানো হতে থাকে, কিন্তু ত্রুটি রয়েই যাচ্ছিল। যে কারণে পরীক্ষাটি ব্যর্থ হয়। ফের ১৯৮৬ সালে পরীক্ষাটি পুনরায় শুরু হয়।
দুর্ঘটনার দিনের ভয়াবহতার চিত্র
পরপর প্রায় একই সঙ্গে ২ টি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চেরনোবিল। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চতুর্থ পারমাণবিক চুল্লির ওপরের প্রায় এক হাজার টন ওজনের কংক্রিটের ঢাকনা সরে যায় এবং ছাদ ভেঙে যাওয়ার ফলে এক বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়। যার ফলে দুর্ঘটনার ২০ ঘণ্টা পরও জ্বলতে থাকে আগুনের লেলিহান শিখা। ভয়াবহতা প্রাণ নাশক হয়ে পড়ে যখন পারমাণবিক চুল্লির দাহ্য পদার্থ বাইরের বাতাসে মিলিয়ে যায়। এই দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত পারমাণবিক ধূসর ঘন কালো মেঘ ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে, গ্রেট ব্রিটেনে এমন কি পূর্ব আমেরিকার ওপর পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল।
কয়েক লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এই দুর্ঘটনায়
এই অভিশপ্ত দিন কেড়ে নেয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান ৪ জন কর্মী। পরবর্তীতে ২৩৭ জন মানুষ পারমাণবিক বিকিরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং প্রথম তিন মাসে ৩১ জন মৃত্যুবরণ করে, যাদের অধিকাংশই উদ্ধারকর্মী। সরকারি হিসেবে বলছে, সেসময় প্রায় ৪ হাজার এবং পরে এর প্রভাবে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদের মধ্যে ছয় লক্ষ শিশু বলেও জানা যায়।
আজও চেরনোবিলের রয়েছে ধ্বংসস্তূপ। খবর অনুযায়ী, উচ্ছেদের আগে শহরটিতে প্রায় ১৪,০০০ বাসিন্দা ছিল। যেখানে বর্তমানে মাত্র ১ হাজার লোক বাস করে।
সেদিনের দুর্ঘটনার পিছনে যে ভুলগুলি ছিল
আজ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রাশিয়ার চেরনোবিল দখলের পর স্মৃতি রোমন্থিত হচ্ছে সেই ভয়াবহতার। যে ভয়াবহতার ইতিহাস গোটা বিশ্বের কাছে একটি 'কালো দিন' হয়ে রয়ে যাবে।