পরীমনিকে নিয়ে তোলপাড় বাংলাদেশ। প্রতিদিন তাঁর ব্যক্তি জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ অফিসার গোলাম সাকলায়েনের সঙ্গে সম্প্রতি তাঁর একটি ঘনিষ্ঠ ভিডিও সামনে এসেছে। তা এখন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন সকলে। কীভাবে নায়িক হয়ে উঠেছিলেন তিনি, কতগুলি বিয়ে করেছেন, তা নিয়ে তুফান উঠছে চায়ের আড্ডায়। এর মাঝেই এবার নিজের প্রতিক্রিয়া দিলেন বাংলাদেশের আরেক অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নতুন ওয়েব সিরিজ 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি' (REKKA) দৌলতে বাঁধন এপার বাংলাতেও এখন পরিচিত মুখ। সম্প্রতি বাংলাদেশে পরীমনিকে নিয়ে যা শুরু হয়েছে তা নিয়ে সেদেশের এক সংবাদপত্রে কলাম ধরেন বাঁধন। অভিনেত্রী লিখেছেন, "একজন মানুষ হিসেবে আজ আমি খুব আতঙ্কিত! কারণ যতটা ভাবার চেষ্টা করি সমাজ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয়- এই সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়? সমাজের তথাকথিত ‘আদর্শ নারী’ না হয়ে নারী যখনই নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করেছে প্রথমেই তাদের ‘কুরুচিপূর্ণ’ শব্দ দিয়ে চরিত্রে আঘাত করা হয়েছে। নারী জীবন নিয়েও শঙ্কায় থাকে। কারণ আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী। নিজের ঘনিষ্ঠ স্বজন, স্বামী এমনকি বাবা-মাও তার মেয়েকে মেরে ফেলে! শুধু তাদের সঙ্গে মতানৈক্য না-হওয়ার কারণে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এই বাস্তবতা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি; দেখতে চাই না, চোখ বন্ধ করে রাখি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই চোখ বন্ধ করে রাখলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।"
বাঁধন আরও লিখেছেন, "যারা মনে করেন, আমরা একটা সুবিধাজনক জায়গায় আছি; ভালো আছি, সুতরাং এসব বিষয় দেখার দরকার নেই, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- যে সমাজে, যে রাষ্ট্রে একজন মানুষ অনিরাপদ, তার স্বাধীনতা বা অধিকার সে বুঝে পায় না, সেখানে আসলে সবাই অনিরাপদ। সবাই বঞ্চিত। আপাতদৃষ্টিতে আমরা মনে করছি, এই ঘটনা তো আমার সঙ্গে হচ্ছে না সুতরাং আমি নিরাপদ। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, অন্যায় যার সঙ্গেই ঘটুক সেটা অন্যায়। এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও অধিকার এবং কর্তব্য। ফলে এই জায়গায় আমরা চুপ করে থাকতে পারি না।"
পরীমনি প্রসঙ্গে বাঁধন লিখেছেন, "পরীমনির ক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে যা করা হচ্ছে সেটা নেক্কারজনক। এটাই সমাজের আসল চেহারা। এই মিডিয়া ট্রায়ালের কোনো দরকার ছিল না। আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, তবে প্রথমে প্রমাণ, এরপর বিচার, শাস্তি। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তিরও কম-বেশি ব্যাপার আছে। কিন্তু তা যদি সমাজ বা রাষ্ট্রের একেবারেই লিঙ্গভিত্তিক আচার আচরণ হয়ে যায়, সেটা দুঃখজনক, ভয়ের এবং আতঙ্কের। কারণ এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আমার। এই সমাজে আমি বসবাস করি।"
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন মেয়েকে আরেকজন মেয়ের পেছনে লেলিয়ে দেয়াটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এই প্রসঙ্গে নিজের উদাহরণও টেনেছেন অভিনেত্রী। লিখেছেন, "আমি আমার জীবনে অনেক কিছু ফেস করেছি। অনেক কঠিন সময় পার করেছি। ওই সময় আমার পরিবারও আমাকে নিজের মনে করেনি। একজন মেয়ে যখন যৌন হয়রানির শিকার হয়, তখন তার পরিবার বা নিজের মানুষই আগে তার দিকে আঙ্গুল তোলে। আমার পরিবার, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, মিডিয়া, রাষ্ট্রযন্ত্র সমাজ ব্যবস্থার বাইরে না। এটাই আমাদের এখানকার সিস্টেম। এই সিস্টেম আমাদের বদলাতে হবে। একটা জাতি এভাবে অন্ধত্ব গ্রহণ করতে পারে না, এখান থেকে আমাদের বের হতে হবে। এই মুক্তি ছাড়া কোনোভাবেই আমাদের অগ্রগতি হবে না।"
বাঁধন আরও লিখেছেন। "পরীমনিকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে হারে ট্রল হচ্ছে এটা বিভৎস! এই মাধ্যমে দিনের পর দিন মেয়েরা শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাই যখন দেখি, এই কাজ আরেকজন নারী করছেন। নিজেকে গৌরবান্বিত করার জন্য অন্য নারীকে হেয় করেন তারা।" প্রসঙ্গত পরীমনির সমর্থনে প্রথম থেকেই সোশ্য়াল মিডিয়ায় গর্জে উঠেছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন (Taslima Nasrin)। আপাতত বাংলাদেশের র্যাব-এর হেফাজতে রয়েছেন পরীমনি। তারই মাঝে ফেসবুকের পাতায় নিজের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করলেন তসলিমা। তাঁর প্রশ্ন রিমান্ডে থাকা পরীমণিকে ধর্ষণ করা হচ্ছে না তো? তসলিমা লিখেছেন, ‘এই যে পরীমনিকে রিমান্ডে নিচ্ছে দিনের পর দিন, রিমান্ডে তো শুনেছি মানুষকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়।’ তিনি এ বিষয়েও নিশ্চিত যে, রিমান্ডে নিয়ে পরীমনির মানসিক নির্যাতন হচ্ছেই। পাশাপাশি তাঁর আরও দাবি, পরীমনি একে ‘মেয়ে, তার ওপর সুন্দরী। তাকে যে কত ভাবে পুরুষেরা এক্সপ্লয়েট করে’!
পরীমনিকে হায়নাদের থেকে বাঁচান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এমন আবেদন করতে দেখা গেছে প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক আব্দুল গফ্ফরকে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা তথা প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী পাশে দাঁড়িয়েছেন অভিনেত্রী পরীমনির। অভিযুক্ত অভিনেত্রীর হয়ে বছর ৮৬-র এই লেখক-সাংবাদিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেছেন। পরীমনির সঙ্গে যা করা হচ্ছে, তাকে সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে যেহেতু নারীর ক্ষমতায়ন শুরু হয়েছে, সেজন্যই তাঁর প্রতি এই আবেদন রেখেছেন তিনি।
ফেসবুকে 'জাস্টিস ফর পরীমনি'
ফেসবুকে 'জাস্টিস ফর পরীমণি' ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন অনেকে। গত ৪ অগাস্ট গ্রেফতার হওয়ার পর পরীমণিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। সিনেমার শিল্পীদের সংগঠন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিও পরীমণির সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত করে। কিন্তু এবার পরীমণির পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন অনেকে। জানাচ্ছেন ঘটনার প্রতিবাদ। একজন চলচ্চিত্র শিল্পীর বাড়িতে হুট করে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার নিয়েও সমালোচনা করছেন অনেকে। পরীমণির সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে বলেও লিখছেন কেউ কেউ। 'জাস্টিস ফর পরীমণি' লেখা পোস্টার ফেসবুকে শেয়ার করে প্রতিবাদ করছেন নেটিজেনদের একাংশ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশি পরিচালক ইস্পাহনি আরিফ জাহানের ফেসবুক ওয়ালে এমন একটি পোস্টার দেখা যায়। এর আগে সেদেশের প্রখ্যাত গীতিকবি প্রিন্স মাহমুদ পরীমণিকে 'টানাহ্যাঁচড়া' না করার অনুরোধ জানান। এদিকে পরীমণির জন্য প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আহ্বান করেছেন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান। কবি জগদীশ বড়ুয়া পার্থ আজ বৃহস্পতিবার পরীমণির মুক্তি চেয়ে মানবন্ধন করেছেন প্লেসক্লাবের সামনে। সেই মানবন্ধনের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে।