২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বড়সড় বদলের ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোপালে একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ব্যবহারের অভিযোগ করছে কংগ্রেস-সহ সমস্ত বিরোধী দলগুলি। এর আগে আইন কমিশন ১৫ জুলাই পর্যন্ত অভিন্ন দেওয়ানিবিধি নিয়ে ধর্মীয় সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মতামত চেয়েছে। ধর্মীয় সংগঠনগুলিও ইউসিসির পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। ইউসিসির নিয়ে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে, এতে ব্যক্তিগত আইনে কী প্রভাব পড়বে?
ইউনিফর্ম সিভিল কোড (UCC) কী?
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানে ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে ভারতে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি অভিন্ন আইন। মানে প্রত্যেক ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের জন্য একই আইন। সিভিল কোড কার্যকর হলে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান দত্তক এবং সম্পত্তি ভাগের মতো বিষয়ে সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন নিয়ম থাকবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৪-এর অংশ। এটি সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন নাগরিক বিধি বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব।
বর্তমানে ভারতে বিভিন্ন ধর্মের নিজস্ব আইন রয়েছে। যেমন- হিন্দুদের জন্য হিন্দু ব্যক্তিগত আইন। মুসলমানদের জন্য মুসলিম ব্যক্তিগত আইন। এমতাবস্থায় এসব ব্যক্তিগত আইন বাতিল করে একটি সাধারণ আইন আনাই ইউসিসির উদ্দেশ্য। আসুন জেনে নিই যদি ইউসিসি বাস্তবায়িত হলে কোন ধর্মের কেমন প্রভাব পড়বে?
হিন্দু ধর্মের উপর কী প্রভাব?
যদি UCC আসলে বিদ্যমান আইন যেমন হিন্দু বিবাহ আইন (১৯৫৫), হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (১৯৫৬) সংশোধন করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে, হিন্দু বিবাহ আইনের ধারা ২(২) বলে যে এর বিধানগুলি তফসিলি উপজাতিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আইনের ধারা ৫ (৫) এবং ৭ অনুযায়ী, প্রথাগত অভ্যাসগুলি বিধানগুলির উপর প্রাধান্য পাবে৷ কিন্তু ইউসিসিতে আসার পর কোনও ছাড় মিলবে না।
ইসলাম ধর্মের উপর কী প্রভাব?
মুসলিম ব্যক্তিগত (শরিয়ত) আইন ১৯৩৭ অনুযায়ী,বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং ভরণপোষণ শরিয়ত বা ইসলামি আইনের অধীনে প্রযোজ্য হবে। ইউসিসি লাগু হলে শরিয়ত আইনে নির্ধারিত বিয়ের ন্যূনতম বয়স পরিবর্তন হবে। বহুবিবাহের মতো প্রথা বন্ধ হয়ে যাবে।
শিখ ধর্মের উপর কী প্রভাব?
শিখদের বিবাহ সংক্রান্ত আইনগুলি ১৯০৯ সালের আনন্দ বিবাহ আইনের অধীনে আসে। তবে এতে তালাকের কোনও বিধান নেই। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য হিন্দু বিবাহ আইন প্রযোজ্য হয়। ইউসিসি আসলে একটি সাধারণ আইন সব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। আনন্দ বিবাহ আইনও শেষ হতে পারে।
পার্সিদের উপর কী পরিবর্তন?
পার্সি বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ আইন ১৯৩৬-এ একটি বিধান রয়েছে, যে কোনও মহিলা যে অন্য কোনও ধর্মের পুরুষকে বিয়ে করেন তিনি পার্সি রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠানের সমস্ত অধিকার হারাবেন। ইউসিসি কার্যকর হলে এই বিধানটি শেষ হয়ে যাবে। এ ছাড়া জরথুস্ত্র ধর্মে দত্তক কন্যাদের অধিকার দেওয়া হয় না। যদিও দত্তক পুত্র শুধুমাত্র পিতার শেষকৃত্য সম্পাদন করতে পারে। ইউসিসি চালু হলে অভিভাবকত্ব ও লালন-পালন আইন সব ধর্মের জন্য সাধারণ হয়ে যাবে।
খ্রিস্ট ধর্মে কী প্রভাব?
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির লাগু হলে উত্তরাধিকার এবং দত্তক গ্রহণ সম্পর্কিত ব্যক্তিগত আইনকে প্রভাবিত করে। খ্রিস্ট ধর্মে বিবাহবিচ্ছেদ আইন ১৮৬৯-এর ধারা ১০এ(১)অধীনে পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করার আগে স্বামী এবং স্ত্রীর জন্য কমপক্ষে দুই বছর আলাদাভাবে বসবাস করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ইউসিসি আসার পর তা শেষ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইন খ্রিস্ট ধর্মে মায়েদের মৃত সন্তানদের সম্পত্তিতে কোনও অধিকার দেয় না। এই ধরনের সমস্ত সম্পত্তি পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়। UCC এলে এই বিধানটিও শেষ হয়ে যাবে।
আদিবাসীদের উপর কী প্রভাব?
আদিবাসী সমাজ চলে ঐতিহ্য ও প্রথার ভিত্তিতে। ইউসিসি আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সকল প্রচলিত আইনের অবসান ঘটবে। CNT অর্থাৎ ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন, সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইন, SPT আইন, PESA আইনের অধীনে ঝাড়খণ্ডে জমি সংক্রান্ত আদিবাসীদের বিশেষ অধিকার রয়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে এই অধিকারগুলি শেষ হয়ে যাবে।
ইউসিসি লাগু হলে সারা দেশে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক এবং উত্তরাধিকারের আইন অভিন্ন হবে। এ অবস্থায় নারীরা সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাবে। সেক্ষেত্রে কোনো অ-উপজাতি যদি কোনও উপজাতি নারীকে বিয়ে করে,সেক্ষেত্রেও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের নারী জমির অধিকার পাবে।