কৌশিক বিশ্বাস
শিরোনামটা পড়ে প্রথমেই চমকে উঠলেন তো? চমকানোরই কথা। যে সরস্বতী দেবীকে আমরা বিদ্যার দেবী হিসেবে ফি বছর সাতসকালে চান-টান করে, সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরে, গাঁদাফুল ছুঁড়ে পুজো করে আসছি, তিনিই নাকি মর্ত্যে মন্থরা অবতার গ্রহণ করে নেমেছিলেন? এটাও আবার বিশ্বাস করতে হবে নাকি! বিশ্বাস না হলেও, এটাই কিন্তু আপাতত সবথেকে বড় সত্যি। অন্তত পুরাণ কিন্তু সেকথাই বলছে।
আমরা সকলেই কমবেশি রামায়ণের গল্প পড়েছি। সেখানে দেখেছি, রাজা দশরথ বৃদ্ধ হওয়ার কারণে তিনি আর রাজ্যপাট সামলাতে পারছিলেন না। সেকারণে তিনি তাঁর বড় ছেলে রামের উপর দায়িত্বভার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাম রাজা হবে শুনে গোটা অযোধ্যা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কারণ গোটা রাজ্যে রামের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ভালো ছিল। কিন্তু, গোটা রাজ্যে আনন্দিত ছিলেন না মাত্র একজন। দশরথের মেজ বৌ কৈকেয়ী। কারণটা কী? কৈকেয়ীর এক চাকরানি ছিল, নাম মন্থরা। সে গিয়ে রানির কানে চুপিচুপি বলল, যদি রাম একবার রাজা হয়ে যায়, তাহলে তাঁর ছেলে ভরত এই বিশাল রাজ্যপাটের কিস্যু পাবে না। এই কথা শুনেই বিগড়ে গেলেন রানি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর কাছে যান। আর সব কথা খুলে বলেন। দশরথ কৈকেয়ীকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলেও, তাতে লাভ তেমন হয়নি। বসেছিলেন নিজের গোঁ ধরে। এদিকে দশরথও সিংহাসনে রাম ছাড়া অন্য কাউকে আর ভাবতে পারছেন না। এমন একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজের শেষ চালটা চাললেন কৈকেয়ী। রাজাকে মনে করিয়ে দিলেন, তিনি দুটো বর দেবেন (এটা আরেকটা গল্প, পরে নাহয় কোনওদিন আলোচনা করা যাবে) বলে প্রমিস করেছিলেন। ব্যাস, এবার রাজা যাবেন কোথায়! কথা যখন দিয়েছেন, পালন তো করতেই হবে। বাধ্য হয়ে রামকে ১৪ বছরের বনবাসে পাঠিয়ে দিলেন। আর রামও বাধ্য ছেলের মতো বাবার আদেশ পালন করেন। পরে অবশ্য রাম যখন ফিরে আসেন, তখন মন্থরা নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে রামের পায়ে লুটিয়ে পড়েন। আর রঘুপতি তাঁকে ক্ষমাও করে দেন।
মোটামুটিভাবে একটা গোটা মহাকাব্যে এই হল মন্থরার ভূমিকা। কিন্তু, মন্থরা কেন এমন কাজ করতে গেল। নেহাতই সাংসারিক কুটকচালি নাকি এর পিছনে আরও কোনও গভীর কারণ রয়েছে। পূরান মতে, আসলে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে রাম হচ্ছে সপ্তম। আর ভগবান বিষ্ণু অবতারের একটাই লক্ষ্য ছিল, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। যদা যদা হি ধর্মস্য, গ্লানি ভবতি ভারত, অভ্যুত্থানম অধর্মস্য, তদাত্মানম সৃজাম্যহম। পরিত্রানায় সাধুনাং, বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম, ধর্ম সংস্থাপনার্থায়, সম্ভবামি যুগে যুগে।
যাকগে, সে কথা। মোদ্দা কথায় ফেরা যাক। রাম রাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাকী দেবতারা ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি নিজের জীবন শুধুমাত্র উপভোগ করেই কাটিয়ে দেবেন। দুষ্টের দমন আর তাঁর দ্বারা হবে না। এহেন সময়ে তাঁরা সবাই মিলে ভগবান বিষ্ণুর কাছে আসেন। গোটা ব্যাপারটা খোলসা করেন। বিষ্ণু দেখলেন, এ তো মহা বিপদ। তিনি দেখলেন, রাম যদি দুষ্টের দমন করতে নাই পারেন, তাহলে একটা অবতার তাঁর ব্যর্থ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরস্বতীকে গোটা ব্যাপারটা জানালেন।
খানিক হেসে সরস্বতী বললেন, কোনও চিন্তা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি নিজে মন্থরা অবতার গ্রহণ করেন এবং মর্ত্যে আসেন। এরপর রামকে কোন কারণে বনবাসে পাঠানো হল, সেকথা তো আপনাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছি। বনবাস চলাকালীন পঞ্চবটী বনে সুর্পনখার নাক কাটলেন লক্ষণ। আর সেটায় আঁতে ঘা লাগল রাবনের। তিনি সীতাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে চলে এলেন। অবশেষে রাম-রাবনের যুদ্ধ। সেই একই ক্লাইম্যাক্স। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। মধুরেন সমাপয়েত।
কিন্তু, সরস্বতী যে মন্থরা তার প্রমাণই বা কী আছে? আপনারা এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন। পূরাণ বলছে, জিভের সাহায্যেই তো আমরা কথা বলি। আর জ্ঞান না থাকলে তো আর কেউ কথা বলতে পারে না। সেক্ষেত্রে সরস্বতীই একমাত্র জ্ঞান এবং কথাবার্তার দেবী। সেকারণে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ভগবতী ভারতী দেবী মন্থরা হয়ে কৈকেয়ীর কানে আসল ফুসমন্তরটি দিয়ে গিয়েছিলেন। আর একটা পরামর্শেই গোটা কাম তামাম। রামেরও সেইসময় রাজ্যাভিষেক হল না। পাশাপাশি রাবণকেও তিনি হত্যা করে গোটা মানবজাতিকে তিনি সুরক্ষিত করলেন। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
তবে রাবণকে কি আদৌ ভিলেন বলা চলে? উত্তরটা না হয় আপনাদের জন্যই ছেড়ে দিলাম।