রবিবার রথযাত্রা। ওড়িশার পুরীধামে জগন্নাথদেবের মন্দিরে চলছে রথযাত্রার প্রস্তুতি। প্রতিবার আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই দিন ভগবান জগন্নাথ তাঁর ভাই বলরাম এবং বোন শুভদ্রার সঙ্গে ভ্রমণে যান। তার আগে তিনি মন্দির ত্যাগ করেন। জগন্নাথ-বলরাম ও শুভদ্রার এই ভ্রমণ কর্মসূচিকে রথযাত্রা বলা হয়। রথযাত্রার সময় রথের দড়ি বা রশি টানলে পূণ্য হয়। এমনটা মনে করেন ভক্তরা। তাই সেদিন দেবতাদের দর্শন পেতে ও রথের রশি টানতে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত করেন।
রথযাত্রা একদিনের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান। তবে এর প্রস্তুতি সারা বছর ধরে চলে। সেই মকর সংক্রান্তির দিন থেকে মন্দিরে রথ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তারপর নিয়ম মেনে প্রতিটি আসন্ন তারিখের সঙ্গে ধাপে ধাপে রথ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। প্রতিটি তিথি এবং কোন দিনে কী কাজ করণীয় তা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। দেবতাদের পোশাক, রথ কেমন হবে, কোন দিন রথ সাজানো হবে- সব কর্মসূচির দিন আগে থেকে ঠিক করা থাকে। যেমন রথযাত্রার আয়োজনের মাত্র ১৫ দিন আগে জগন্নাথদেবের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, যখন প্রচণ্ড গরম থাকে, তখন দেবতাদের মূর্তিগুলিকে ১০৮ কলস জল দিয়ে স্নান করানো হয়। এই স্নানের পরই তিন দেবতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই কারণে নির্জনে চলে যান। এই প্রক্রিয়াকে পুরীতে 'আনাসার' বলা হয়। এই ১৫ দিন দেবতাদের আর দেখা যায় না। জগন্নাথদেব ১৫ দিন পর সুস্থ হয়ে উঠলে, সেই দিন 'নয়নসার উৎসব' পালিত হয়। এই দিন জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রা আবার সাজেন। নতুন পোশাক পরেন এবং তারপর যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। তারপর রথগুলিকে মন্দিরের সিংহদ্বারে নিয়ে আসা হয় এবং দুদিন পর সেখান থেকেই রথযাত্রা শুরু হয়। বলা হয়, জগন্নাথদেব অসুস্থতার কারণে বেশ কয়েক দিন একা থাকেন। তবে যখন ঘুরতে যান তখন তিনি ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে যান। এই ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্য হল হাওয়া বদল।
এখানে প্রশ্ন জাগে ঈশ্বরও কি অসুস্থ হয়ে পড়েন? কেন এবং কিভাবে? এই প্রশ্নগুলোর নেপথ্যে রয়েছে এক করুণ কাহিনি। ভগবান জগন্নাথদেবকে নিয়ে জনপ্রিয় লোকশ্রুতি রয়েছে।ভক্ত মাধবদাস ওড়িশার পুরী অঞ্চলে থাকতেন। তিনি প্রতিদিন ভগবানের আরাধনা করতেন। প্রসাদ হিসেবে যা পেতেন তাই নিয়ে বেঁচে থাকতেন এবং সরল জীবনযাপন করতেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড জ্বর হয়। তিনি একা ছিলেন তাই তাঁর সেবা করার কেউ ছিল না। তারপরও ভগবানের প্রতি তাঁর ভক্তি কমেনি। সবাই তাঁকে ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলেও তিনি যাননি। মাধবদাসও বলতেন, 'ভগবান যখন আমার যত্ন নিচ্ছেন, তখন আমার কাউকে লাগবে কেন?' কিন্তু, একদিন মাধব দাস অসুস্থতায় দুর্বল হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
শোনা যায়, ভক্ত মাধবদাসকে কষ্টে দেখে ভগবান স্বয়ং মন্দির থেকে বের হয়ে তাঁর সেবা করতে শুরু করেন। জগন্নাথদেব তাঁকে ওষুধ দিতেন এবং হাত-পা টিপে দিতেন। নিজের হাতে স্নান করাতেন, খাবার খাওয়াতেন। মাধবদাস যখন সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, স্বয়ং ভগবান তাঁর সেবায় নিয়োজিত। এই দেখে মাধবদাস কেঁদে ফেললেন।
তিনি বললেন, 'আমার সেবা করতে এসেছেন কেন? আপনি আমাকে অবিলম্বে নিরাময় করতে পারেন। তখন জগন্নাথদেব বলেন, 'আমি আমার ভক্তদের ছাড়ি না, তবে তাদের কপালে যা লেখা আছে তা অবশ্যই হবে। তোমার অসুস্থতার আরও ১৫ দিন বাকি আছে। আমি তা নিজের উপর নিচ্ছি।' সেদিন ছিল জ্যেষ্ঠ পূর্ণিমা।
এই ঘটনার পর জগন্নাথদেব মন্দিরে যান। স্মান করেন। তারপর জ্বরে আক্রান্ত হন। তখন তিনি নির্জনে চলে যান। কথিত আছে যে, জগন্নাথদেব যেমন ভক্ত মাধবদাসের বেদনা নিজের উপর নিয়েছিলেন, তেমনি তিনি প্রতি বছর তাঁর ভক্তদের ব্যথা নিজের উপর নেন। ১৫ দিন পর প্রভু সুস্থ হয়ে উঠলে, নয়নসার উৎসব পালিত হয়। এরপরই ভগবান ভ্রমণের জন্য বের হন। একে রথযাত্রা বলা হয়।
প্রভু জগন্নাথের আবাসস্থল পুরীর শ্রীমন্দিরে প্রতি বছর আনাসারের অনুষ্ঠান করা হয়। একে পূর্ণিমাও স্নানও বলা হয়। গরম থেকে স্বস্তি পেতে, মন্দিরের দেবতারা স্নান উৎসবে ১০৮ কলসি ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করেন। এই রাজকীয় স্নান অনুষ্ঠানের পরে তিন দেবতাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫ দিনের জন্য জনসাধারণের দর্শন থেকে দূরে থাকতে হয়। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা দিয়ে শুরু হয় এবং আষাঢ় অমাবস্যায় শেষ হয়।
দেবতারা ১৫ দিন যখন বিশ্রাম নেন তখন মন্দিরে দেবতার রঙিন চিত্রগুলির পুজো করা হয়। এই চিত্রগুলিতে ভগবান জগন্নাথকে ভগবান বিষ্ণু, ভগবান বলভদ্রকে ভগবান শিব এবং দেবী সুভদ্রাকে আদিশক্তি রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। সকালে মঙ্গলারতি করা হয় এবং প্রদীপ জ্বালানো হয়। এরপর দেবতাদের দন্তধাউতি দেওয়া হয় (দাঁত মাজা, মুখ পরিষ্কার করা) এবং তারপর স্নান করা হয়। পোশাক অলংকার পরিষ্কার করা হয়।
যখন আষাঢ়ের কৃষ্ণ পঞ্চমী তিথি আসে, তখন মন্দিরে আনাসার পঞ্চমী পালিত হয়। বৃহস্পতিবার, আনাসার পঞ্চমী উপলক্ষে, মহাপ্রভু জগন্নাথ এবং তাঁর ভাইবোন ভগবান বলভদ্র এবং দেবী সুভদ্রাকে 'ফুলুরি' তেল চিকিৎসা দেওয়া হবে। ফুলুরি তেল পরিষেবা নামে পরিচিত। দেবতাদের প্রতিমায় ফুলুরি তেল লাগানো হয়। এই বিশেষ আচারটি ভগবান জগন্নাথ এবং তাঁর ভাইবোনদের 'স্নানযাত্রা' চলাকালীন অতিরিক্ত স্নানের কারণে সৃষ্ট জ্বর থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য করা হয়।
ফুলুরি তেল পদ্ধতির জন্য, কেতকী, মল্লি, বাউলা এবং চম্পা, শিকড়, চন্দন কাঠের গুঁড়া, কর্পূর, চাল, শস্য এবং ভেষজ জাতীয় সুগন্ধি ফুলের সঙ্গে তেল মিশিয়ে ‘ফুলুরি’ তেল তৈরি করা হয়। ফুলুরি তেল তৈরিতে ব্যবহৃত ২৪টি উপাদানের মধ্যে খাঁটি তিলের তেল, বেনার শিকড়, জুঁই, জুই, মাল্লি এবং চন্দনের গুঁড়ার মতো সুগন্ধি ফুল থাকে। প্রতি বছর রথযাত্রার পঞ্চম দিনে 'হেরা পঞ্চমী' উপলক্ষে প্রস্তুতি শুরু হয় এবং প্রায় এক বছর মাটির নিচে সংরক্ষণ করার পর তা ব্যবহারের জন্য মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রথযাত্রার একদিন আগে 'নব জবানা দর্শন' উপলক্ষে ফুলুরি তেল চিকিত্সার পরে তিন দেবতাই তাদের অসুস্থতা নিরাময় করে রথযাত্রা করেন।