বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ভারতীয় (Unity In Diversity) সংস্কৃতির ভিত্তি। খাদ্য, বসবাস বা ধর্মাচার, সব ক্ষেত্রেই সেই প্রাচীন কাল থেকে সৌভ্রাতৃত্বের সুতোয় বাঁধা ভারতবাসী। যুগে যুগে শাসক বদলেছে, বদলায়নি ভারতের মাটি এবং ভারতবাসীর মননে মিশে থাকা এই ঐতিহ্য। বারে বারে সমাজ সংস্কারকরাও দিয়ে গিয়েছেন সেই ঐক্যের বার্তাই। সমাজের প্রয়োজনে অনেক সময় পারস্পরিক নৈকট্যও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছে হিন্দু ও মুসলমান (Hindu - Muslim) সম্প্রদায়ের ধর্মচার ও বিশ্বাস। সৃষ্টি হয়েছে সত্যপীরের (Satya Pir)। কিন্তু তারপরেও বারে বারে এই দেশের হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ছবিতে লেগেছে রক্তের দাগ। ধর্মের জিগির তুলে ধ্বংস হয়েছে মন্দির মসজিদ। ঘটে গিয়েছে বাবরি মসজিদ (Babri Masjid) ধ্বংসের মতো ঘটনাও।
ইতিহাস বলছে, ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের ফলে ভেঙে পড়েছিল বাংলার প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সমস্ত জড়তা সরিয়ে রেখে একে অপরের কাছাকাছি আসতে শুরু করেন হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন। পাশাপাশি ইলিয়াস শাহ, হুসেন শাহদের আমলের হিন্দু - মুসলিম মেলবন্ধনের সেতু তৈরি হয়। পরবর্তীকালে দুই ধর্মের মিলন ধারাকে আরও বৃহত্তর রূপ দেন শ্রী চৈতন্যদেব। সেই মিলন স্রোতে ভাসতে ভাসতেই সপ্তদশ শতকে দেখা গেলে একই দেহে মিশে গিয়েছেন হিন্দুর নারায়ণ ও মুসলমানের পীর। সৃষ্টি হয়েছেন সত্যপীর। বিশেষজ্ঞদের মতে সত্যনারায়ণ এবং সত্যপীরের পুজোও একই বিশ্বাসে হয়।
সত্যপীরের পালাগানেও বারে বারে উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই। এই প্রসঙ্গে শেখ মহম্মদ সুফি নামে এক পালাশিল্পী জানাচ্ছেন,"মানুষকে ভালোবাসাই প্রথম ও প্রধান ধর্ম। মানুষকে ছাড়া কিছু বুঝি না। মানুষের মধ্যেই ভগবান। মানুষ ছাড়া ভগবান থাকতে পারেন না।" তিনি আরও বলেন, "গীতা ও কোরানেও এই কথাই আছে। ভগবান বলেছেন, কেউ আমায় ভালোবাসতে চাইলে যেন মানুষকে ভালোবাসে। আবার খোদাও বলেছেন, কেউ যদি আমায় ভালবাসতে চায় তবে সর্বপ্রথম যেন মানুষকে ভালবাসে।" তাই শিল্পী সুফির মতে, "মানুষের মধ্যে এত হানাহানি শয়তানের কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।" লালন ফকিরও স্বপ্ন দেখতেন, জাতি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে তৈরি হবে সমাজ। তাই তো লালন প্রশ্ন তুলেছিলেন, 'এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে? যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান, জাতি গোত্র নাহি রবে।' আর লালনের সেই প্রশ্নের উত্তর যেদিন মিলবে সেদিনই পাওয়া যাবে চিরস্থায়ী মৈত্রীর ঠিকানা।