উমা চলে গিয়েছে তাঁর বাপের বাড়ি। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোও শেষ। এবার পালা কালীপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোর। তবে মা লক্ষ্মী যে একেবারে বিদায় নিয়েছেন তা কিন্তু একেবারেই নয়। পূর্ণিমা তিথিতে যেমন মা লক্ষ্মী পূজিত হন তেমনি কালীপুজোর দিন অমাবস্যা তিথিতেও পুজো করা হয় মা লক্ষ্মীকে। যা অলক্ষ্মী বিদায় নামে পরিচিত। কিন্তু অমাবস্যাতেই কেন মা লক্ষ্মীর পুজো করা হয়?
কালীপুজোর দিন মা লক্ষ্মীর পুজো
এই নিয়ে পুরাণে ভিন্ন মত রয়েছে। তবে প্রচলিত সত্য হল, কালী পুজোর দিন অর্থাৎ দীপান্বিতা অমাবস্যায় বহু বাড়িতেই দেবী অলক্ষ্মীর পুজো করা হয়। যদিও সেটা পূর্ববঙ্গীয়দের রীতি নেই, এদেশীয় বা ঘটিদের বাড়িতেই এই পুজোর চল বেশি করে দেখা যায়। আসলে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর সময় যখন দেবী লক্ষ্মী আসেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে আসেন অলক্ষ্মীও। কালী পুজোর দিন অশুভ নাশ করে শুভ শক্তির আগমন করার সঙ্গেই এই অলক্ষ্মীকেও পুজো করে বিদায় জানানো হয়। এই অলক্ষ্মী কথাটি যদিও সমাজে ভালো শব্দ নয়।
লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী দুই বোন
পুরাণ মতে, এই অলক্ষ্মী আসলে কিন্তু লক্ষ্মীর দিদি। এঁদের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও নানান মুনির নানান মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখের আলো থেকে জন্ম নিয়েছেন লক্ষ্মী আর পিঠ থেকে জন্ম হয়েছে অলক্ষ্মীও। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনিটি হল সমুদ্রমন্থনের। সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে উঠে আসা অমৃতের পাত্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন দেবী লক্ষ্মী। আর তার ঠিক আগেই নাকি জন্ম নেন অলক্ষ্মী। যে পুরাণ মতই আপনি মেনে চলুন না কেন, সব দিকেই এটাই বোঝায় যে, দেবী লক্ষ্মী ও দেবী অলক্ষ্মী হলেন দুই বোন। সব দিক থেকেই যেন বোন লক্ষ্মীর বিপরীত তিনি। তাঁর মতো শান্ত স্বভাবের নন, সৌভাগ্যের প্রতীকও নন। বরং পুরাণ ও শাস্ত্রে দেবী অলক্ষ্মীকে বর্ণনা করা হয়েছে কুরূপা, ঈর্ষা ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। গাধার পিঠে চেপে তিনি হাজির হন ঘরে ঘরে…।
কেন পুজো হয় অলক্ষ্মীর
তাহলে তাঁর আরাধনা কেন করা হয়? তাও কালীপুজোর দিনেই? অমঙ্গল ও অশুভের প্রতীক হলেও, অলক্ষ্মীকে ভগবতীর এক রূপ বলে মনে করা হয়। আমাদের সবার মধ্যেই সাদা এবং কালো— দুটি দিকই আছে। কখনও কখনও হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষে ভরে উঠি আমরা। আমাদের ভেতরের ‘লক্ষ্মী’র সঙ্গে ঢুকে যায় অলক্ষ্মীও। কিন্তু তাঁকেও তো দরকার। কালো না থাকলে কি সাদাকে চেনা যায়? সেইজন্যই কালীপুজোর দিন লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী দুজনেরই পুজো করা হয়। ঠিক যেমন দুর্গাপূজায় দেবী দুর্গার সঙ্গে আসেন মহিষাসুরও। মনে করা হয়, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সময় দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে হাজির হন অলক্ষ্মীও। তাই তাঁকে পুজো করেই বিদায় করা হয়। আর এমন কাজ করার জন্য কালীপুজোই হল আসল দিন। যখন অশুভের নাশ করতে শুভ শক্তির উদয় হয়…।
অলক্ষ্মী পুজোর নিয়ম
লক্ষ্মীপুজোর মতোই আল্পনা দেওয়া হয় এইদিন। কালীপুজো বলে চারিদিকে থাকে আলোর রোশনাই। তার মধ্যেই শুরু হয় অলক্ষ্মী পুজো। গোবর দিয়ে তৈরি করা হয় অলক্ষ্মীর মূর্তি; আর পিটুলি দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং কুবেরের মূর্তি। পুজো হয়ে গেলে মেয়েরা অলক্ষ্মীর সেই মূর্তিটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। সঙ্গে শোনা যায় সমবেত ধ্বনি, ‘লক্ষ্মী আয়, অলক্ষ্মী যা’। এইভাবেই ঘরের সব অশুভকে অলক্ষ্মীর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে রেখে আসেন তাঁরা। ভেতরে থেকে যান কেবল লক্ষ্মী। সাদা আর কালো নিয়ে বসবাস করলেও, কালো যেন আমাদের গ্রাস না করে, সেই প্রার্থনাই চলতে থাকে এই পুজো জুড়ে।
এই কারণে কালীঘাটে কালী পুজোর সন্ধ্যায় সবার আগে পুজো করা হয় দেবী অলক্ষ্মীর। দীপান্বিতা অমাবস্যায় দক্ষিণাকালীই মহালক্ষ্মী রূপে পূজিতা হন। তবে কালীঘাটে মহালক্ষ্মী ও ধনলক্ষ্মী উভয়েরই আরাধনা করা হয়। এই বছর কালীপুজো পড়েছে ১২ নভেম্বর। এদিনই পূজিত হন অলক্ষ্মী।