ইজরায়েল বনাম ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্ব চলছেই। দুই দেশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কোনও বিরাম দেখা যাচ্ছে না। এই আবহে সোশ্যাল মিডিয়ায় দুটি ছবি বেশ ভাইরাল হচ্ছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত মুখে ব্যান্ডেজ পরে এক বৃদ্ধা বসে রয়েছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি কুকুর হিংস্র ভঙ্গিতে এক বৃদ্ধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এই দু'টি ছবি শেয়ার করে লেখা হয়েছে, ফিলিস্তিনের এক বৃদ্ধা নিজের বাসস্থান ছেড়ে বেরোতে চাননি। ঠিক এই কারণে ইজরায়লি বাহিনী তাঁর উপর হ্রিংস কুকুর লেলিয়ে দেয়। সেই কুকুরের কামড়ে ওই বৃদ্ধার একটা হাত, শরীরের কিছু অংশ এবং মুখের কিছু ভাগ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ছবি দুটি ওই ফিলিস্তিনি মহিলার বলেই দাবি করা হয়েছে।
ছবি দু'টি শেয়ার করে পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "আহঃ দৃশ্য!
-নিজের বাসস্থান ছাড়তে অস্বীকার করায় ফি,লি,স্তি,নি এক বৃদ্ধা মায়ের উপর বিশ্বের খ্যাতসম্পন্ন মা/লা/উ/ন রা কুকুর লেলিয়ে দেয়। তারপর সেই কুকুর তাঁর একটা হাত, শরীরের কিছু অংশ এবং মুখের কিছু ভাগ কামড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়।"
আজতক ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে এই পোস্টটি অর্ধসত্য এবং বিভ্রান্তিকর। কারণ প্রথম ছবিটি ফিলিস্তিনের নয়। দ্বিতীয় ছবিটিও আসল নয়। তৃতীয়ত ওই বৃদ্ধার মুখ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবিটি অসত্য। যদিও কুকুর দিয়ে হামার ঘটনা বাস্তবে ঘটেছে।
কীভাবে জানা গেল সত্যি
সবার প্রথম কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি যে ফিলিস্তিনে সম্প্রতি এমন কোনও ঘটনা আদৌ ঘটেছে কিনা। তখন সিয়াসত ডট কম, দ্য নিউজ আরব, এবং মাকতুব মিডিয়ার মতো একাধিক সংস্থার প্রতিবেদন আমাদের নজরে পড়ে। সেখানেই এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে লেখা হয় যে, গাজা স্ট্রিপের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে এই ৬৬ বছর বয়সী মহিলার সঙ্গে এমনই ঘটনা ঘটেছে।
এরপর আমরা পোস্টে থাকা ছবি দুটির উৎস সন্ধান করতে শুরু করি। ক্ষতবিক্ষত মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা ওই বৃদ্ধার ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে খুঁজতে আমরা ওই ছবিটি ফরিদ আলহোর নামে এক সিরিয়ান চিত্র সাংবাদিকের ভ্যারিফায়েড ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেলে দেখতে পাই। গত ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ওই ছবিটি পোস্ট করেন।
ছবিটি পোস্ট করে তিনি ক্যাপশনে লেখেন, "সিরিয়ার এই বৃদ্ধার নাম রাসমিয়া মাসরি, বয়স ৭৯ বছর। সিরিয়ার ইদলিবের অদূরে এফিস টাউনে তার বাড়ি লক্ষ্য করে আসাদ বাহিনীর বোমা হামলা চালায় যেখানে তিনি আহত হন।" এর থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই আহত বৃদ্ধার ছবিটি ফিলিস্তিন বা গাজার কোনও অংশের নয় এবং এর সঙ্গে চলমান সংঘর্ষের কোনও সম্পর্কই নেই।
এরপর যখন আমরা দ্বিতীয় ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, তখন ওই একই ছবি মরোক্ক ওয়ার্ল্ড নিউজের একটি খবরে দেখা যায়। ২৬ জুন প্রকাশিত মহিলার উপর কুকুরের হামলা নিয়েই এই খবরটি করা হয়েছিল। এই প্রতিবেদনের কভারে আলোচিত ছবিটি প্রকাশ করে তার নীচে লিখে দেওয়া হয়, "আক্রমণের কল্পিত চিত্র।" অর্থাৎ এটি কোনও আসল ছবি নয়। বরং একটি ইলাস্ট্রেশন মাত্র।
সবার শেষে আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি যে ভাইরাল পোস্টের দাবি অনুসারে কুকুরের হামলায় মহিলার হাত, শরীরের কিছু অংশ এবং মুখের কিছু ভাগ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি কতটা সত্য। কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আমরা ২৬ জুন প্রকাশিত আল জাজিরার একটি খবর দেখতে পাই। যেখানে ওই মহিলাকে ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দিতে ও পূর্ণাঙ্গ ঘটনার বিবরণ দিতে শোনা যায়। নীচে আল জাজিরার এই এক্স পোস্টে কুকুরের হামলার আসল ভিডিও এবং আক্রান্ত ওই মহিলার সাক্ষাৎকার দেখতে পাওয়া যাবে।
الجزيرة تحصل على مقاطع مسربة من كاميرا ركّبها جنود الاحتلال على كلب بوليسي تظهر اعتداء الكلب على مسنة فلسطينية في بيتها خلال عملية كان جيش الاحتلال بصدد القيام بها في مخيم جباليا قبل أسابيع#الأخبار #حرب_غزة pic.twitter.com/UrFMCridTZ
— قناة الجزيرة (@AJArabic) June 25, 2024
বলাই বাহুল্য, এই আক্রমণের ঘটনায় যে তাঁর মুখ ছিন্নবিচ্ছন্ন হয়ে যায়নি সেটা উপরের ছবি থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও এ কথা সত্যি যে কুকুরের হামলায় তাঁর হাত বেশ আহত হয়েছে এবং বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ভাইরাল পোস্টে যে ছবিগুলি পোস্ট করে ওই দাবি করা হয়েছে, তা অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর ও পূর্ণ সত্য একেবারেই নয়।
দুটি ছবিতে এক ফিলিস্তিন বৃদ্ধাকে দেখা যাচ্ছে যিনি নিজের বাসস্থান ছাড়তে অস্বীকার করায় ইজরায়লী বাহিনী কুকুর লেলিয়ে দেয় এবং সেই হামলা বৃদ্ধার একটা হাত, শরীরের কিছু অংশ এবং মুখের কিছু ভাগ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বসে থাকা বৃদ্ধার ছবিটি ফিলিস্তিনে নয়, বরং সিরিয়ার এক বৃদ্ধার। দ্বিতীয় ছবিটি আসল ঘটনার একটি কল্পিত চিত্র মাত্র।