একুশের ভোটে তিনিই ছিলেন তৃণমূলের গোলরক্ষক। লড়াই করে রাজ্যের ২১৩ আসনে ঘাসফুলের জয় নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু নিজের ঘর বাঁচাতে পারেননি। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র নন্দীগ্রামে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হারতে হয়েছিল তৃণমূলনেত্রীকে। তারপরেই প্রশ্ন উঠেছিল ভোটে পরাজিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারবেন? ভারতের ১৯৫১ সালের জন-প্রতিনিধিত্ব আইন বলছে, কোন দল সরকার গঠন করলে এবং সেই দলের নির্বাচিত সদস্যরা যদি কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করে, সেক্ষেত্রে তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্ব পাবেন। ফলে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে মসনদে বসার ৬ মাসের মধ্যে উপনির্বাচন থেকে জিততে হবে তৃণমূলনেত্রীকে। কিন্তু সেই ছয় মাস যদি পেরিয়ে যায় এবং নির্বাচন না হয় সেক্ষেত্রে কী হবে? তাহলে কি মুখ্যমন্ত্রীর আসন ধরে রাখতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
ভারতীয় সংবিধান কী বলছে?
ভারতীয় সংবিধানের ১৬৪(৪) নং ধারা অনুযায়ী, নির্বাচনে না জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়। তবে মসনদে বসার ৬ মাসের মধ্যে তাঁকে অন্য কোনও আসন থেকে জিতে আসতে হবে। এভাবে তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন ১৮০ দিন বা ছয় মাস। এই সময়সীমার মধ্যে তাঁকে কোন একটি আসনে উপনির্বাচনে জিতে আসতে হবে। নয়তো ছয় মাস পর ছেড়ে দিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর পদ। এরআগে ২০১১ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার সময়ও বিধায়ক ছিলেন না মমতা। পরে উপ নির্বাচনে জিতে ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হন তিনি। কিন্তু এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যা পরিস্থিতি তাতে ছয় মাসের মধ্যে বাংলায় উপনির্বাচন হবে তো? আর তা না হলে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?
উপর্নিবাচন নিয়ে প্রশ্ন
এক মাস হল ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনও হাতে রয়েছে ৫ মাস। ইতিমধ্যে ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। শোনা যাচ্ছে এই আসন থেকেই উপনির্বাচনে লড়তে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কমিশন আদৌ ৫ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে তো? একদা অটল বিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য তথা বর্তমানে তৃণমল নেতা যশবন্ত সিনহা সম্প্রতি একটি বিস্ফোরক ট্যুইট করেন। যেখানে তিনি লেখেন, একটি ছোট পাখি তাঁকে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন আগামী ছয় মাসে উপ নির্বাচনের আয়োজন করবে না। তারা এটি ইচ্ছাকৃতভাবেই করছে যাতে মমতা কোনভাবেই জিতে না আসতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই তার এই ট্যুইট ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় পড়ে গেছে।
৫ মে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন মমতা। সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী ছ’মাসের মধ্যে তাঁকে বিধায়ক নির্বাচিত হতে হবে। মমতার ভবানীপুরে জয় নিয়ে সংশয় নেই কারও। কিন্তু উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা তো করবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। এমনিতেই বাংলায় আট দফায় ভোট করিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে কমিশন। এই আবহে কোভিডের পুরো অবসান না হলে বাংলায় উপনির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তৃণমূলের নেতাদের একটি অংশের আশঙ্কা, করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে না নির্বাচন কমিশন অনির্দিষ্টকাল উপনির্বাচন ঝুলিয়ে রাখে। ৫ নভেম্বরের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীকে ভোটে জিতে বিধায়ক হওয়ার শর্তপূরণ করতে হবে।
করোনার কারণে উপনির্বাচন না হওয়ার নজির
করোনা সংক্রমণের কারণে বিধানসভা উপনির্বাচন না হওয়ার নজির বাংলায় রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছিলেন ফালাকাটার তৃণমূল বিধায়ক অনিল অধিকারী। কিন্তু করোনা সংক্রমণের কারণে সেখানে দেড় বছর ভোট হয়নি। সদ্যসমাপ্ত বিধানসভার ভোটে ওই আসনে জিতে বিধায়ক হয়েছেন বিজেপি-র দীপক বর্মন। এমন নজিরই তাই চিন্তায় রেখেছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। অক্টোবরে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে দেশে। বিভিন্ন স্তরে প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে। কমিশন যদি করোনার কারণ দেখিয়ে উপনির্বাচন স্থগিত করে রাখে তাহলে কী হবে?
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
কংগ্রেস নেতা তথা বিশিষ্ট আইনজীবী অরণাভ ঘোষ আজতক বাংলাকে জানিয়েছেন, ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন না হলে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তার বদলে অন্য কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসও। বিকল্প পথ খুঁজে নিয়ে কীভাবে প্রশাসন পরিচালনা করা যাবে, তাই নিয়ে দলের অন্দরে আলোচনাও চলছে। তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে মমতাকে মুখ্যমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে একদিন পর আবার শপথ নিতে হবে।
মমতার দুই মন্ত্রীরও ভাগ্য ঝুলে রয়েছে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও রাজ্য মন্ত্রিসভায় আরও দুই সদস্য রয়েছেন, যাঁদের আবার জিতে এসে মন্ত্রী থাকতে হবে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র একুশের নির্বাচনে ভোটে লড়েননি। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ভবানীপুর বিধানসভা থেকে জিতেও পদত্যাগ করেছেন বিধায়ক পদ থেকে। খড়দহ বিধানসভা থেকে শোভনবাবু প্রার্থী হচ্ছেন তা স্থির। তবে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র উপনির্বাচনে সম্ভবত প্রার্থী হচ্ছেন না। অন্যদিকে জঙ্গিপুর ও সামশেরগঞ্জ আসনে প্রার্থীদের মৃত্যুর কারণে ভোট হয়নি। আর খড়দহ কেন্দ্রে বিজয়ী প্রার্থী কাজল সিনহা ফলাফল ঘোষণার আগেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এদিক সাংসদ থেকে যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্তে দিনহাটা ও শান্তিপুর আসন থেকে পদত্যাগ করেছেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক ও জগন্নাথ সরকার। তাই উপনির্বাচন হবে ওই দুই আসনেও। বিধানসভা ভোটের পর যে ৬টি আসনে ভোট হবে তাতে মোটামুটি তৃণমূলেরই জেতার সম্ভাবনা। ফলে বিজেপির কেমন তাগিদ নেই নির্বাচন নিয়। এখন নির্বাচন কমিশন কী করবে? সত্যিই ছয় মাসের মধ্যে উপ নির্বাচনের আয়োজন করবে কি না সেটাই দেখার।