মহম্মদ শামি একটা লড়াইয়ের নাম। তিনি ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের গর্জনের নামও। তিনি বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন। তিনি যখন সেরা ফর্মে বিরাজ করছেন, সেইসময় তাঁর দিকে আইনি সমস্যা ছুটে এসেছে। সেইসময় পুরো ভারতীয় দল তাঁর পাশে ছিল। তিনি বিশ্বকাপে এসে তার প্রতিদান দিচ্ছেন। এই খেলোয়ারের জীবন শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে। সেই সময়ে তিনি থাকতেন টাউন ক্লাবের কর্তা এবং পরে সিএবি-র সহ-সচিব দেবব্রত দাসের বাড়িতে।
দেবব্রত দাস থাকতেন গরচা রোডের একটি বাড়িতে। সেখানেই থাকতেন মহম্মদ শামি। দেব্রবত দাস জানিয়েছিলেন, এক গরমকালের কথা। বাতানুকূল যন্ত্র চলছে। কখন যে তা বিকল হয়ে আগুন ধরে গিয়েছে, খেয়ালই করেনি কেউ। ধোঁয়া বেরোতে দেখে পাড়ার লোক জমতে শুরু করে দিল একটু পরে। ঘরের মধ্যে যিনি আছেন তাঁর কোনও হুঁশ নেই। বারবার দরজা ধাক্কা দেওয়ার পরেও সাড়াশব্দ দিচ্ছেন না। আর দেরি না করে তিনি ঠিক করলেন, দরজা ভাঙবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তার পর হুড়মুড়িয়ে সকলে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। এবং এক রাশ উদ্বেগ আর আতঙ্ক নিয়ে ঢুকে দেখলেন, ভিতরে যিনি ছিলেন, দিব্যি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করে তবেই তোলা গেল তাঁকে। বাতানুকূল যন্ত্র থেকে যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, বড় বিপদ এসে পৌঁছেছে শিয়রে, দেখে কে বলবে! তিনি যেন সম্পূর্ণ অন্য জগতে। তিনিই মহম্মদ শামি।
কয়েক বছরের মধ্যে সেই শামিই ভারতের এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার হয়ে উঠবেন। কলকাতা ময়দান থেকেই অভাবনীয় উত্থান উত্তর প্রদেশের সহাসপুরে বড় হওয়া শামির। প্রচণ্ড ঘুমকাতুরে তিনি এক দুপুরে এমনই কাণ্ড বাধিয়ে এলাকায় ত্রাহি ত্রাহি রব ফেলে দিয়েছিলেন। দেবব্রত সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘প্রচণ্ড ঘুমোতে ভালবাসে। কিন্তু সে দিন সত্যিই খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কোনও সাড়াশব্দই পাচ্ছিলাম না।’’
শামির জীবন একেবারে গলি থেকে রাজপথে উঠে আসার এক কাহিনি। যার পদে-পদে রোম খাড়া করে দেওয়া সব মুহূর্ত। নাটকীয় সব মোচড়। আর সেই কাহিনিতে বড় ভূমিকা কলকাতা ময়দানের। শামির বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে পেস বোলার হোক। কিন্তু সহাসপুরে পড়ে থেকে কী করে বড় ক্রিকেটার হবেন তিনি? তাই কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে। প্রথম ডালহৌসি ক্লাবের সুমন চক্রবর্তীর নজরে পড়েছিলেন তিনি। জোরজার করে তবু ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ডালহৌসি ক্লাবের দলে। শামি তাঁর অধিনায়কের মাথা নিচু হতে দেননি। কলকাতার ক্রিকেট ময়দানে উদয় ঘটল এক সত্যিকারের ফাস্ট বোলারের।
ডালহৌসি ক্লাবের একটা ছেলে খুব জোরে বল করছে— লোক মারফত বার্তা পৌঁছল টাউন ক্লাবের শীর্ষ কর্তা দেবব্রতের কানে। তিনি ছুটলেন সেই এক্সপ্রেস গতির বোলারকে দেখতে। বিরিয়ানি খেতে ভালবাসেন শামি। টাউনের হয়ে খেলার সময় অনেক ম্যাচে তাঁকে বিরিয়ানির টোপ দিয়ে প্রলুব্ধ করতেন দেবব্রত। বাউন্ডারি লাইন ধরে তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়ে বলতেন, ‘‘উইকেট পড়ছে না শামি। উইকেট তোল, বিরিয়ানি আনাচ্ছি।’’ শামি পরখ করে নিতেন টাউন কর্তার কথা। ‘‘কথা দিচ্ছ তো?’’ তার পরেই বলে উঠতেন, ‘‘বল দিতে বলো আমাকে।’’ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতোই তাঁর হাতে বল উঠলে যেন জাদুকরি ক্ষমতা ভর করত। এর পর তিন-চারটি উইকেট একাই উপড়ে ফেলতেন তিনি। আর তাঁবুতে ফিরে চলত বিরিয়ানি উৎসব।
এখন কোটিপতি ক্রিকেটার হয়ে উঠেছেন শামি। উত্তর প্রদেশে ফার্ম হাউস রয়েছে। সেখানে ফিটনেস চর্চার জন্য অত্যাধুনিক জিম বসিয়েছেন, সুইমিং পুল তৈরি করেছেন। এ দিন জানা গেল, নিজস্ব ট্রেনারও রেখেছেন তিনি। আজ কে বিশ্বাস করবে, শুরুর সেই সময়ে কলকাতায় খেলা থাকলে দিন প্রতি একশো টাকা পেতেন তিনি!
কলকাতায় টাউন কর্তা দেবব্রতের বাড়িতে থেকেছেন অনেক বছর। টাউনের হয়ে খেলার সময়েই বাংলার প্রধান নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে খবর যায়, ‘লড়কা তেজ ডাল রহা হ্যায়’। সম্বরণের সঙ্গে কথা হল দেবব্রতের। শামিকে স্থানীয় ম্যাচে বল করতে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন সম্বরণ। টাউন ক্লাব থেকে বাংলা দলে ঢুকে পড়লেন শামি। এর পরে বাংলার অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্লের সমর্থন তাঁকে আরও দ্রুত এগিয়ে দিল ভারতীয় ক্রিকেটের হাইওয়ের দিকে।
সহাসপুর থেকে ক্রিকেটের নেশায় কলকাতায় আসা এক আত্মভোলা তরুণ। যাঁর পৃথিবী বলতে ছিল জোরে বল করা, স্টাম্প ছিটকে দেওয়ার মধুর শব্দ, বিরিয়ানির প্যাকেট আর কুম্ভকর্ণের ঘুম। ঠিকানা বলতে কখনও ক্লাব ক্যাপ্টেন বা ক্লাব কর্তার বাড়ি। গরচা রোডে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চের নায়ক।