১৬ জানুয়ারি ১৯৪১। ৮০ বছর আগে ব্রিটিশদের চোখে ধূলো দিয়ে কলকাতার বাসভবন থেকে আফগানিস্তান পাড়ি দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেই ঘটনা ইতিহাসে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণ নামে পরিচিত। সেই রাতে ঠিক কী হয়েছিল ? কে কে জানতেন যে নেতাজি ছদ্মবেশে চলে যাবেন ? এমন নানা তথ্য এই প্রতিবেদনে তুলে ধরব। পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা জানাব, যেগুলো সচারচর আলোচিত হয় না।
এই নেতাজিই একসময় বলেছিলেন, 'ভারত আমাদের ডাকছে, রক্ত দিয়ে রক্তকে ডাকছে, আর সময় নেই। অস্ত্র তোলো, ঈশ্বর চাইলে শহিদের মৃত্যু বরণ করে নেব আমরা।' জীবনের পরতে পরতে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বীরের শুধু জন্ম হয়, বীরত্বের কোনও অন্ত নেই। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি একবার, দুবার নয় নেতাজির ১৯ বার মৃত্যুর কথা শোনা যায়। সেই ১৯৪২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। কখনও বিমান দু্র্ঘটনা, কখনও জেলে বন্দী অবস্থায় ইত্যাদি। তবে সেটা বলার আগে আরও কিছু তথ্য দেব।
নেতাজির জন্ম ওড়িশার কটকে। তবে তাঁর পূর্ব পুরুষের আদিবাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে। সোনারপুর লোকাল লাইনে এই গ্রামটি সুভাষগ্রাম পরিচিত নাম। এই কোদালিয়ায় সুভাষচন্দ্র বসু শৈশবের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। দুর্গাপুজোর সময় এলগিন রোডের বাড়ি থেকে কোদালিয়ায় সপরিবারের চলে আসত বসু পরিবার। মান্দালয় সেন্ট্রাল জেল থেকে দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে দুর্গাপুজো নিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সেই তাঁর ছোটোবেলার দুর্গাপুজোর স্মৃতি তিনি চিঠিতে বর্ণনা করেছিলেন।
সুভাষচন্দ্র বসু কী খেতে ভালোবাসতেন?
দেশের এই বীর সন্তান ছিলেন তেলেভাজার ভক্ত। মুগডালের খিচুড়িও ছিল তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায়। তাঁর দীক্ষাগুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবীর কাছে খিচুড়ি খেতে চাইতেন। এছাড়া সুভাষচন্দ্র বসু যখন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্কটিশ চার্চে চলে আসেন তখন নিয়মিত ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’ সাউয়ের দোকানে তেলেভাজা খেতে যেতেন।
মহানিষ্ক্রমণের সেই রাত ও নানা তথ্য
ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, সেকথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু, সেদিন রাত্রে নেতাজি সেজে তাঁরই ঘরে আলো জ্বেলে শুয়েছিলেন এক মহিলা। তিনি ইলা বসু। সুভাষচন্দ্র বসুর সেজ দাদা সুরেশচন্দ্র বসুর দ্বিতীয়া কন্যা ছিলেন এই ইলাদেবী। তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি জানতেন সেই রাত্রে কী হতে চলেছে। ইলাদেবী নেতাজিকে রাঙাকাকু বলে ডাকতেন। সেদিন রাত ১টা বেজে ৩৫ মিনিট। মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশ ধরে নেন সুভাষচন্দ্র বসু। আদেশ ছিল, তিনি চলে যাওয়ার পরেই যেন তাঁর ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। সেই আদেশের বিন্দুমাত্র অমান্য করেননি ইলাদেবী। সকলের সন্দেহ এড়াতে তিনি নিজেই ওই ঘরে একঘণ্টা বা তারও বেশি সময় চুপচাপ শুয়ে থাকেন। এমনকী নেতাজি চলে যাওয়ার পরও দিনদশেক তাঁকে খাবার দেওয়ার ভান করেন। যাতে কেউ সন্দেহ না করে।
আবার নেতাজি ভারত ছাড়ার আগে দক্ষিণেশ্বর কালীমায়ের পায়ের ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে। মহানিষ্ক্রমণের ঠিক কয়েকদিন আগে তিনি ভাইজি ইলা বসুকে ফুল ও চরণামৃত নিতে পাঠিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে।
নেতাজির ছদ্মবেশ
মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তবে সেই শেষ নয়, ইওরোপে প্রবেশ করার সময় নাম পালটে তিনিই হয়ে গেলেন অর্ল্যান্ডো মাজোত্তা। আবার জাপানে থাকার সময় ফের নাম বদলে সুভাষচন্দ্র হয়ে যান মাতসুদা।
নেতাজির ১৯ বার মৃত্যুর কথা শোনা যায়
এই তথ্য সামনে এনেছেন নেতাজি গবেষক ডক্টর জয়ন্ত চৌধুরী। নেতাজিকে নিয়ে তাঁর একাধিক বই রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম, 'ক্ষমা করো সুভাষ' নামক বইটি। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, নেতাজির ১৯ বার মৃত্যুর কথা শোনা যায়। লেখকের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে। সেই বইতে উল্লেখও আছে বা কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৯৪২ সাল, ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাস, সেই বছরেরই অগাস্টে একাধিকবার, এরপর ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরেও একাধিকবার, ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের শাহনাজ কমিটির রিপোর্ট, ১৯৫৫ সালে রাশিয়ায়, ১৯৬৮ সাল, ১৯৭৪ সাল, ১৯৭৭ সাল, ১৯৮৫ সাল, ১৯৯২ সাল, ২০০১ সালের মে মাস, ২০০৪ সালের নভেম্বর, ২০০৫ এর নভেম্বরে মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট এবং ২০০৫ এর অক্টোবর- এই সব মিলিয়ে ১৯ বার নেতাজির মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সামনে এসেছে। এইগুলির মধ্যে রয়েছে বিমান দুর্ঘটনা, জেলেবন্দী অবস্থায় মৃত্যুর মতো নানান কথা।