বিষয় মাইথোলজি বনাম মিথ্যা। কলকাতায় সাহিত্য আজতকের মঞ্চে এই চিরকালীন বিতর্ক নিয়ে নিজের অভিমত প্রকাশ করলেন পুরাণবিদ দেবদত্ত পট্টনায়েক। তাঁর মতে,''হিন্দুত্ববাদীরা ভাবেন মিথ থেকে মাইলোলজি করেছে ব্রিটিশরা। আসলে এটা গ্রিক শব্দ মিথোস এবং লোগোসের মিশ্রণ। মিথোস মানে আখ্যান, আর লোগোসের অর্থ চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ করা।'
রামায়ণ ও মহাভারত কি ইতিহাস? দেবদত্তের কথায়,'এটা আখ্যান বলতে পারি, ইতিহাস নয়। সংস্কৃতিতে ইতিহাস শব্দের অর্থ যিনি দেখেছেন বা প্রত্যক্ষদর্শী। বাল্মিকী রামায়ণের পাত্র। ব্যাস প্রত্যদর্শী। আদি পুরাণ মার্কণ্ডেয় ঋষি নারদের কাছ থেকে বৃত্তান্ত শুনেছেন। তিনি বিষ্ণুর শয়ন দেখেননি। শিবের বিয়েতে যোগ দেননি।'
ধর্ম কী? ঈশ্বর কে? দেবদত্তের জবাব, '১৭০০ বছর পুরনো মনুস্মৃতিতে ধর্মের কথা আছে। ধর্ম শব্দ বেদেও আছে। তবে সেখানে তা এতটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ নয়। এটা আধার হিসেবে ব্যবহৃত। শতপথ ব্রাহ্মণে এই শব্দ শোনা গিয়েছে। বলবান শক্তিহীনদের শোষণ করলে তা অধর্ম। বিষ্ণুপুরাণের প্রথম অবতার, মৎস্য অবতার। সেই কাহিনিতে বড় মাছদের থেকে ছোট মাছকে বাঁচান মনু। মাৎস্যন্যায় তার বিপরীত। শক্তিহীনকে শোষণ করে শক্তিশালীরা। সমাজে তা হলে তা অধর্ম। সমাজে মানুষের মধ্যে সেই ক্ষমতা আছে যে শক্তিহীনদের রক্ষা করে শক্তিশালীরা।'
দেবদত্ত বলেন,'অন্য ধর্মে ঈশ্বর বলতে বোধায় যিনি দুনিয়া তৈরি করেছেন। সব জীবজন্তুর উপরে রয়েছে মানুষ। তিনি পয়গম্বরের মাধ্যমে মানুষকে বার্তা দিয়েছেন। পয়গম্বরের কথা মানলে হালাল। না মানলে হারাম। হালাল হলে স্বর্গ পাবেন। তবে সনাতন ধর্মে ভগবান বা দেবতার কনসেপ্ট অনন্ত। এখানে পুনর্জন্ম আছে। দেবতাদের যজ্ঞের মাধ্যমে আবহ্বান করি, আহুতি দিই। দেবতা প্রসন্ন হলে কিছু দেন। মানে দেবতাদের খিদে পায়। তাই তাদের আহ্বান করতে হয়। শিবের কোনও দাবি নেই। তাই তিনি মহাদেব। যজ্ঞ পরম্পরার সঙ্গে তাঁর যোগ নেই। তিনি দেবেন না, নেবেনও না। বিবাহের পর তিনি কৈলাস ছেড়ে সমতলে কাশীতে আসেন। সন্ন্যাসী গার্হস্থ্য হয়েছেন। সংসার করছেন।'
ঈশ্বর-তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা এগিয়ে গেল ত্রিদেবীর দিকে। দেবদত্তের বলে চলেন,'যা ভোগ করেন সেটাই লক্ষ্মী। প্রতিটি মানুষই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তাঁর শক্তি দরকার। সেজন্য শক্তির পুজো করি। দুর্গ কেন বানাই, কারণ কেউ যাতে আক্রমণ না করে। এখানে কলকাতায় দুর্গাপুজো হয় শক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাঁর হাতে থাকে হাতিয়ার। যিনি নিরাপত্তাহীন নন, তাঁর হাতে অস্ত্রও থাকে না। বিদ্যার দেবী সরস্বতী। আমাদের কেন ঈশ্বর তৈরি করেছেন? এর উত্তর কারও কাছে নেই। আমরা দুনিয়ার রহস্য জানি না। আমরা লক্ষ্মী বা দুর্গার পিছনে দৌড়োই। আমরা টাইমপাস করি। আমাদের কাছে রহস্য, কেন আমরা পৃথিবীতে এলাম? বিদ্যা মনকে সম্প্রসারিত করে। আমরা ব্রহ্মের কাছাকাছি যাই। কারণ জ্ঞান পাই।'
সত্য কী? পুরাণবিদ বলেন,'দুনিয়া আপনি ছাড়াও চলবে। কল্পতরু মরে গেলেও জঙ্গল বাড়তে থাকবে। দু'দিন লোকে কাঁদবে। মূর্তিও বানিয়ে দেবে। শ্রীকৃষ্ণও মহাভারতের যুদ্ধ আটকাতে পারেননি। অহংকারের সামনে ভগবানও মাথানত করে। ভগবান হয়েও পত্নীর ত্যাগ করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ নিজের চোখের সামনে যাদব বংশের সর্বনাশ দেখছেন।'
মৃত্যু কী? দেবদত্তের উত্তর,'যখন খিদে পাবে না। আমরা জানি না মৃত্যুর পর কী হয়! খৃষ্ট্র ও ইসলামে মৃত্যুর আলাদা অর্থ। মানুষ কথার মাধ্যমে জীবনের সমস্যাকে সমাধান করে। কথা না থাকলে মানুষ পাগল হয়ে যাবে। তাই পুরাণ খুব গুরুত্ববপূর্ণ। মৃত্যু নিয়ে একাধিক কথা আছে। গরুড়পুরাণে একটা কথা আছে। আলাদা আলাদা দুনিয়া আছে। আলাদা আলাদা পিতৃলোক আছে। পুনর্জন্মের কথাও আছে।'
সৌন্দর্য কী? দেবদত্ত বলেন,'সৌন্দর্যের অর্থ ভোগ, যা ইন্দ্রিয়গোচর। কামশাস্ত্রে ভোগের আলাদা আলাদা মানে। অমৃতমন্থনে আলাদা আলাদা ভোগের জিনিস বেরিয়ে এসেছিল।'