সেক্স চেঞ্জ করতে চাইছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা সুচেতনা ভট্টাচার্য। তা নিয়ে এই কদিনে কম আলোচনা হয়নি। সুচেতনার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা মহল থেকে নানা মন্তব্য সামনে এসেছে। সেক্স চেঞ্জ কি নিরাপদ ? আমাদের রাজ্যে এর সুবিধা পাওয়া যায় ? কেমন খরচ হয় ? ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে। যার উত্তর দিলেন মানবী দেশের প্রথম রূপান্তরকামী অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। Bangla.aajtak.in-কে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি।
প্রশ্ন : বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ে সুচেতনা থেকে সুচেতন হতে চাইছেন, আপনার কী প্রতিক্রিয়া ?
মানবী : বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা। তিনি পুত্রে রূপান্তরিত হচ্ছেন এটা আমার কাছে এক অদ্ভূত অনুভূতি!ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না কি নিয়তিবাদের গ্রীক ট্রাজেডি জানি না। বুদ্ধবাবুর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে আমার সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন সার্জারি হয় এবং শাস্তিস্বরূপ আমার পিএইচডি অগ্রাহ্য হয়! আমি রিডার পোস্ট থেকে বঞ্চিত হই এবং আমার প্রাপ্য দুটি ইনক্রিমেন্ট থেকে চিরতরে বঞ্চিত হই! যেটা অকারণ এক বিশাল আর্থিক ক্ষতি! দুহাজার ছয় সালে আমি পিএইচডি অ্যাওয়ার্ডেড হয়েছিলাম! ২০০৩-০৪ সালে আমি লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী হই! বুদ্ধবাবুর সরকার তা মেনে নেন নি! কর্মস্থলে পুরুষ করে রাখা হয়েছিল! ভোটের ডিউটিতে পুরুষদের সঙ্গে ডিউটি দেওয়া হয়েছিল! অপমান অসম্মানের চূড়ান্ত! আত্মহত্যার পথে ঠেলা হয়েছিল! বাবা মা ভয় পেতেন শহর থেকে বহু দূরে গ্রামের কলেজের চাকরিতে খুন না হয়ে যাই! আমাকে ভাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য অভূতপূর্ব অত্যাচার করা হত! চাকরিস্থলে পুরুষ এপিক কার্ডে নারী এভাবে অর্ধনারীশ্বর করে রাখার জন্য কোনো ব্যাঙ্ক লোন পেয়ে একটা থাকার আস্তানা কিনব সে সুযোগ ছিল না! শুধুমাত্র সামাজিক বয়কট চরম দুঃসহ হয়ে উঠে ছিল। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব সুচেতনের যেন আমার অভিজ্ঞতা না হয়! হবেও না! আমি পথ পরিষ্কার করে দিয়েছি অনেক খানি।
প্রশ্ন : সুচেতন জানিয়েছেন, তাঁর সিদ্ধান্তে পরিবারের সম্মতি রয়েছে। আপনার ক্ষেত্রে কেমন ছিল ?
আমার পরিবার বলতে মা বাবা! তাঁরা দুজনেই সমাজের কাছে বৃহত্তর পরিবারের কাছে শুধুমাত্র আমার কারণে বড় অসহায় ছিলেন! বাবা মা আমায় আঁকড়ে ধরতেন। সমাজ তাঁদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে গঙ্গাসাগরে সন্তান নিক্ষেপের মতো হিজড়ে ডেরায় দিয়ে আসতে বলতেন! আমার সময়ে সেক্স চেঞ্জ করলে গুপিবাঘার মতো মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে উল্টো গাধায় চড়িয়ে সমাজের বাইরে বের করে দেওয়া হত! বাবা মায়ের মতামত কাজে আসত না! আমি আট বছর কলেজে অধ্যাপনা করে পয়সা জমিয়ে শরীর তৈরি করেছি। তখন আমার সহ-কর্মীরা যখন ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে বাড়ি বানাতে ব্যস্ত!
প্রশ্ন : সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মানবী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা যদি বলেন।
মানবী : এটা কোনও প্রক্রিয়াজাত উৎপাদন নয়, এটা ছিল মন্ত্রের সাধন শরীর পতন!
প্রশ্ন : সোমনাথ কবে বুঝলেন তিনি মানবী হতে চান? নিশ্চয় পরিবার-প্রিয়জনদের সেই কথা জানিয়েছিলেন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ?
মানবী :জন্ম থেকেই সোমনাথ বুঝেছিলেন তিনি নাথবতী অনাথবৎ ! তাঁকে নিজ মুখে বলতে হয় নি পরিবার প্রিয়জনদের! প্রিয়জনরাই আবিষ্কার করেছিল সোমনাথ নাথবতী!
প্রশ্ন : সোমনাথ থেকে মানবী হয়ে ওঠার চিকিৎসা প্রক্রিয়াটা যদি শেয়ার করেন
মানবী : চিকিৎসা প্রক্রিয়া তখন ভারতে আসেইনি বিদেশের শীলমোহর নিয়ে!অথচ সোমনাথ ডাক্তারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে নারী শরীর মূডিক্যালি পাওয়ার সাধনায়! বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রান্সজেন্ডার ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে! সব ডাক্তার নিরাশ করলেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মৈনাক মুখোপাধ্যায় বর্ধমান মেডিকেল কলেজে আছেন। এখন সম্ভবত এবং প্রখ্যাত এণ্ড্রোক্রোনোলজিস্ক ডক্টর অনির্বাণ মজুমদার আশার আলো জ্বালেন শেষ পর্যন্ত। সার্জারির জন্য কৃতজ্ঞতা ডাক্তার মনোজ খন্না, শশাঙ্ক চট্টোপাধ্যায়, এবং অবশ্যই করে বিখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন ডক্টর মৃন্ময় নন্দীর কাছে।
প্রশ্ন : মানবী হয়ে ওঠার পর আপনার পরিবার-বন্ধুবান্ধবরা কীভাবে বিষয়টা নিয়েছিলেন?
মানবী : পরিবার মরমে মরে গেছিল। কারণ তাঁরা আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন! বন্ধু আমার কেউ ছিল না! সবচেয়ে খিল্লি উড়িয়েছিল বিদগ্ধ সহকর্মী অধ্যাপক সমাজ!সবাই ধরে নিয়েছিল এইভাবে বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান!অনেকেই দিন গুণে ছিল আমার আত্মহত্যা কেবল সময়ের অপেক্ষা!
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গে কি সেক্স চেঞ্জের সুবিধা রয়েছে ? থাকলে কোথায় ?
মানবী : SSKM হাসপাতালে বর্তমান সরকারের বদান্যতায় বিনা ব্যয়ে এই অপারেশনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে প্রায় সাত বছর হতে চলল!
প্রশ্ন : শোনা যায়, অনেকের ইচ্ছে থাকলেও অর্থের অভাবে সেক্স চেঞ্জ করতে পারেন না। এটা কি সত্যি ?
মানবী : যার এটা প্রয়োজন তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না! এটা ইচ্ছা বা শখ নয়, এমার্জেন্সি প্রয়োজন যেমন জটিল অসুখে অস্ত্রোপচার আবশ্যিক!
প্রশ্ন : ৪১ বছর বয়সে সেক্স চেঞ্জ করতে চাইছেন সুচেতনা। এতে তাঁর কী প্রাণসংশয় হতে পারে ? আপনার অভিজ্ঞতা যদি বলেন।
মানবী : একেবারেই না! পিজিতে পঞ্চান্ন বছরের একজন বাংলাদেশির এই অপারেশন হয়েছে তিন চার বছর পূর্বে। এই অপারেশনে প্রাণ সংশয় তো নেইই বরং সচেতনতা নতুন প্রাণ প্রেরণা পাবেন বেঁচে থাকার! ঋতুপর্ণ অপারেশন করলে দীর্ঘায়ু পেতেন বলে আমার বিশ্বাস!
প্রশ্ন : সুচেতনার মতো আরও অনেকেই রয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশে মানবী কী বার্তা দেবেন?
মানবী : সুচেতনার মতো সত্যিই অনেক মানুষ আছেন! তাঁরা আছেন বলেই আমার বেঁচে থাকা সুন্দর!তাঁরা মেঘের আড়াল থেকে বাস্তবে এলে আমাদের শক্তি বাড়বে! কর্মক্ষেত্রে আমাদের মতো মানুষদের কোনো নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত নেই! সুপ্রিম কোর্টের বিচারের বাণী কেন্দ্র রাজ্য সর্বত্রই নীরবে নিভৃতে কাঁদে আজকের দিন পর্যন্ত! এটা ভবিষ্যতে আমাদের মতো মানুষদের এক হয়ে দূর করতে হবে! সুচেতনার সে প্রশাসনিক সামাজিক পারিবারিক সমাধানে ব্রতী হন এটাই চাইব! আমাদের মতো মানুষ ঈশ্বরের অনন্য সৃষ্টি! সাধারণ মানুষের থেকে তারা অনেক গুণ প্রতিভা সম্পন্ন মেধা সম্পন্ন হন, সেই মানব সম্পদ পতিত করে রাখা হয় যেখানে আবাদ করলে ফলতো সোনা! সমাজ আর কতদিন জেগে ঘুমাবে?