'রানাঘাট লোকাল এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৬ থেকে ছাড়বে।' এই ঘোষণা শোনা মাত্র ক'য়েকশ মানুষ হুড়মুড়িয়ে দৌড় লাগান নির্ধারিত প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু জানেন কী, যিনি এই ঘোষণা করছেন তিনি জীবনে প্ল্যাটফর্ম তো দূরের কথা, পৃথিবীর আলোই দেখননি। কারণ তিনি চোখে দেখতে পান না। জন্মান্ধ। তিনি পরিতোষ বিশ্বাস।
যাত্রাপথটা কী মসৃণ ছিল? মোটেও না। নৈহাটির বাসিন্দা পরিতোষ প্রতিদিন ভোর ৫টা নাগাদ নৈহাটি স্টেশনে এসে পৌঁছন ট্রেন ধরতে। হাতে একট লাঠি। তাঁকে কামরা পর্যন্ত পৌঁছে আসে একাধিক হাত। সসম্ভ্রমে। ৬টায় ডিউটি শুরু হয় তাঁর। পৌঁছতে হয় কাঁটায় কাঁটায়। সোজা চলে যান অ্যানাউন্সমেন্ট রুমে। কাজে বসেই নিতে শুরু করেন ফোনের পর ফোন। খবর আসতে থাকে ট্রেনের আপডেট। দ্রুত হাতে ব্রেইলে নোট নেন। তারপরে যথাসময়ে শুরু করেন একের পর এক ঘোষণা।
প্রতি মুহূর্তে ফোন বাজছে। খবর আসছে কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে কোন ট্রেন কখন ছাড়বে। সেই সব তথ্য দ্রুত হাতে ব্রেলে লিখে নেন তিনি। কারণ লিখে না নিলে তো ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তারপরে নিখুঁত সময়ে ঘোষণা করেন মাইক্রোফোনে। শিয়ালদার প্রতিটি কোনে প্রতিধ্বনিত হয় 'অনুগ্রহ করে শুনবেন...।' এভাবেই তাঁর কর্মজীবন এখন ৩৪ বছরে।
দৃষ্টি না থাকা সত্ত্বেও ব্যস্ততম স্টেশনে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়ার জন্য তিনি রেলের কাছে কৃতজ্ঞ। দীর্ঘ কেরিয়ারের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্টেশনে ছিলেন। তবে তিনি একা নন, পূর্ব রেল সূত্রের খবর, হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন মিলিয়ে পরিতোষ বিশ্বাস-সহ মোট পাঁচ জন দৃষ্টিহীন ঘোষক রয়েছেন।
পরিতোষ বিশ্বাসের বাড়িতে আছেন স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে। সহকর্মীরা বলেন, এত দিনের কাজে তিনি ঘোষণা করতে গিয়ে কোনও ভুল করেছেন, তাঁর সহকর্মীদের কারও মনে পড়ে না। তাঁর ঘোষণা শুনে নির্দ্বিধায় সবাই গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যে পৌঁছনোর ট্রেনটি ধরেন। ট্রেনের বগিতে হয়ত তাঁরই সহযাত্রীরা হয়ত জানেন না, যে যিনি ঘোষণা করছেন তিনি আর কেউ নন, পরিতোষবাবু। যার কণ্ঠ শিয়ালদহ স্টেশনের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, 'যাত্রীরা অনুগ্রহ করে শুনবেন...।'