শেখ হাসিনা আর একবার প্রমাণ করলেন, তিনি তাঁর বাবা মুজিবুর রহমান নন। অর্থাৎ তাঁর জীবনে কোনও ‘অসতর্কতা’ বা ‘মার্কিন চাপ’-এর কাছে হেরে যাওয়া নেই। এবং নয়াদিল্লি আশ্বস্ত হল যে, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশে, যে দেশের সঙ্গে আমাদের প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে, সেই দেশে এখনই কোনও ইসলামি মৌলবাদী শক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিতে পারছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই থেকে সরে যাওয়ার আগে জো বাইডেন নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন যে, পৃথিবীর আরও অনেক দেশের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশে অর্থাৎ ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে, যে দেশে আবার সংখ্যাগুরুই মুসলিম, সেই ঢাকাতে ‘স্যাম চাচা’ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকছে না।
একইসঙ্গে এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা গেলেন, অর্থাৎ এত রক্ত ঝরল কেন, তার কারণও শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। যেটা ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, অর্থাৎ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা তুলে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ, সেটাতে যে জামাত-এ-ইসলামি বা বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মদত দিয়ে এত বড় চেহারা দিতে পারে, সেটা কেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বা প্রশাসনের তরফে আন্দাজ করা হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তরও আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে যে, সংসদীয় নির্বাচন থেকে স্থানীয় স্তরে সব ভোটে জিততে গিয়ে যাঁদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন সেই রাজনৈতিক বিরোধীদের জন্য জমি ছাড়তে অসুবিধা কোথায়? কারণ, কোটা বিরোধী আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে, এই বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও প্রয়োজনে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে জামাত যে ‘জ্বালানো পোড়ানো’ নীতি নিয়েই চলবে, সেটা নতুন কথা নয়। কিন্তু জামাতকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে গেলে এবং সামাজিকভাবে রুখতে গেলে অন্য রাজনৈতিক বিরোধীদের যে জায়গা ছাড়তে হবে, এটা আওয়ামী লীগ বুঝলে মঙ্গল। সংসদীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বেশিরভাগ আসনে তাঁরাই জিতবেন এবং বাকি আসনে আওয়ামী লীগের নির্দলরা, এটা খুব চলনসই ফর্মুলা নয়। এই ফর্মুলাকে ভাঙতে পারলে এবং অনেককে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারলে আগামী দিনে আওয়ামী লীগের পক্ষে জামাতের মতো কট্টরপন্থী শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট, যেদিন মুজিবুর রহমান আততায়ীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। সেদিন তিনি আন্দাজই করতে পারেননি, তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছে। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান থাকলেও সেনাবাহিনী আর তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে অনেক রক্তাক্ত সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে জিয়াউর রহমান কুর্সিতে বসেছিলেন। তিনিই পরবর্তীকালে বিএনপি বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টিকে তৈরি করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধরা হয়, আওয়ামী লীগ ‘ভারতবন্ধু’ আর বিএনপি ‘পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ’। কিন্তু ইসলামাবাদের এখন আর সেই রমরমা নেই বলে বিএনপি ঝুঁকেছে পাকিস্তানের আসল ‘প্রভু’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, এবারও কোটা বিরোধী আন্দোলনে মদত দিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করে শেখ হাসিনাকে গদিচ্যুত করে আসলে জিয়া-পুত্র তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। কিন্তু কঠোর হাতে যাবতীয় বিক্ষোভকে দমন করে আর অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের দাবি মতো সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে শেখ হাসিনা ক্ষমতার রাশ নিজের হাতেই রেখেছেন।
বাংলাদেশে রক্তস্নান এবং মানুষের মৃত্যু সবাইকেই বিচলিত করেছে। কিন্তু তার পিছনে জামাতের কতটা হাত রয়েছে বা আমেরিকা পালাবদল চায় কি না, তা না বুঝেই অনেক ‘বিপ্লবী’ এবং ‘প্রতি বিপ্লবী’রা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান তুলেছেন। ঐতিহাসিকভাবে এটা সত্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও চিন এবং চিনপন্থীরা পাকিস্তানের সঙ্গে ছিলেন। অর্থাৎ সেইসময়ও তাঁরা বাংলাদেশে ‘রাজাকার’দের এবং ‘জামাত’দের সমর্থন করেছিলেন। তাই “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।” এই বলে বা ফেসবুকের দেয়ালে সেঁটে সত্যিই কি নিজেদের প্রগতিশীল প্রমাণ করা যাবে? কারণ ‘রাজাকার’ শব্দটির মধ্যে শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা নেই, ১৯৭১-এর ওই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে অস্বীকার করাও আছে।
সৌভাগ্যের বিষয়, শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিকে স্বস্তি দিয়ে বাংলাদেশের রাশ কোনও মৌলবাদী শক্তির হাতে যেতে দেননি।
বিঃ দ্রঃ: এই প্রতিবেদন লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত। bangla.aajtak.in এর দায় নিচ্ছে না।