মানব সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রগতি। কারিগরি প্রগতি যুগে যুগে মানব সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে চলেছে। বর্তমান সময়ের এমনি একটি উদ্ভাবন হল ক্রিপ্টোকারেন্সি। যার আবিষ্কর্তা সাতোনি নাকামোতে। ২০০৮ সালে এটি প্রথম তৈরি হয়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এমনই একটা অর্থনৈতিক লেনদেনের বিনিময়ের মাধ্যম, যেটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা। এটির কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই অথচ মূল্য আছে, যার উপর নির্ভর করে মানুষ লেনদেন করে। ক্রিপ্টোকারেন্সি সংকেত লিপির দ্বারা নির্মিত ও নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ। এটি কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ নয়। কিন্তু, ব্লকচেন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত এই মুদ্রাকে সুরক্ষিত বলে দাবি করা হয়।
এই ক্রিপ্টোকারেন্সির সুবিধাজনক দিকগুলি হল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এর ব্যবহার খুবই সহজ। কারণ, এতে লেনদেন খরচ খুবই কম। আবার খুব অল্প সময়ের মধ্যে লেনদেন করা সম্ভব।
বিটকয়েন হল প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি। বহুল ব্যবহৃত কতগুলি বিটকয়েন হল BTC Bitcoin, ETHEthereum, BNBBinance ও USDTTether। এই প্রযুক্তিতে একটি লেজার বা খাতা ব্যবহৃত হয়। যেটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও অপরিবর্তনীয় । তাই এটি সম্পূর্ণ রূপে সুরক্ষিত বলে দাবি করা হয়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি পৃথিবীর অনেক দেশেই বর্তমানে ব্যবহৃত হয় তবে এই ডিজিটাল কারেন্সির সুরক্ষার প্রশ্নে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। এল সালভাডোর দেশে প্রথম সরকারি মুদ্রার স্বীকৃতি পায়। ইউনাইটেড কিংডমে এটিকে সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয়। যদিও সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ভেনেজুয়েলায় শুধু এয়ারপ্লেনের টিকিট কাটতে এটি ব্যবহার করা যায়।
ভারতবর্ষে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকার সন্দিহান। যে শংকাগুলির কথা ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে তা হল: প্রথমত, এই ডিজিটাল মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আজ্ঞাধীন হবে না, তাই এর নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, এর ফলে তৈরি হতে পারে একটি সমান্তরাল নিয়ন্ত্রণহীন অর্থব্যবস্থা। যা দেশের মূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে পারে। তৃতীয়ত, এর ফলে খুচরো কারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চতুর্থত, এটি ফিনটেক (ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থায় ব্যবহৃত কম্পিউটার পদ্ধতি) কেও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে তুলবে।
২০১৮ সালে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক ভার্চুয়াল কারেন্সির ব্যবহারকে বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। একই বছরে ইন্টার মিনিস্টারিয়াল কমিটি ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার আইনিভাবে বন্ধ করতে বলে। ২০২০ সালের মার্চে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এই বন্ধের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করে।
বর্তমান বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার কিন্তু বেড়েই চলেছে। সারা বিশ্বে এর মূল্য এখন তিন ট্রিলিয়ান ডলার। ২০২০-র অগাস্টে ভারত ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রহণযোগ্যতার হারে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সম্প্রতি T-20 বিশ্বকাপ খেলায় ৫০ কোটির বিজ্ঞাপন হয় এই কারেন্সিতে। ভারতে বর্তমানে দেড় থেকে দু কোটি এই কারেন্সির বিনিয়োগকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। সমগ্র ভারতে এই কারেন্সি বিনিয়োগ আনুমানিক চল্লিশ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে।
এই ভার্চুয়াল কারেন্সি ব্যবহারে যে সমস্যাটি প্রণিধানযোগ্য সেটি হল জালিয়াতির সুযোগ। সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে বিটকয়েন ব্যবহার করে মাদক কেনার জন্য। মাদক ও অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র কেনায় এটি বহুল ব্যবহৃত। তাই এই ভার্চুয়াল কারেন্সি ব্যবহারে যথাযোগ্য সাবধানতা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে ভারত সরকার।
ভারত সরকার ডিজিটাল কারেন্সির সুবিধার দিকগুলোকে মান্যতা দিয়ে The Cryptocurrency and Regulation of official Digital Currency Bill 2021 আনতে চলেছে, চলতি শীতকালীন অধিবেশনে।
যে কোনও প্রযুক্তি মানবসভ্যতার আশীর্বাদ না অভিশাপ এই বিতর্ক চলতেই থাকে। তাই ডিজিটাল কারেন্সির ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করে এর প্রয়োগ চালু রাখার উদ্যোগ নেওয়া হোক। কারণ বিশ্বের দরবারে ভারতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে যেতে হলে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গেই অগ্রসর হতে হবে।