বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে পুরানো স্মৃতিগুলো যখন-তখন অবাধ্য ছেলের মত মনের মধ্যে দাপাদাপি জুড়ে দেয়৷ নগরজীবনের বিলাস বৈভবের মাঝে শরৎ অমাবস্যার প্রাতে মহালয়ার আবাহনী গান শুনতে শুনতে মন হারিয়ে যায় মেদিনীপুরের এক অজগ্রামে কাটানো আমার শৈশবের দিনগুলোতে৷
আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল জমিদার বিষ্ণুপ্রিয়া চৌধুরানিদের বাড়ি৷ স্বাধীনতার পর জমিদারী চলে গেলেও বংশপরম্পরায় চলে আসা দুর্গাপুজো বন্ধ হয়নি। তাঁর নাতি ধুর্জটিপ্রসাদ তখনও বেশ ধুমধাম করে পুজো করতেন৷ আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মধ্যে একমাত্র পুজো হওয়ার সুবাদে মানুষ এসে ভিড় জমাত, পাত পেড়ে প্রসাদ খেয়ে যেত, আনন্দ করত৷ পুজোর মাসখানিক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত প্রতিমা গড়ার কাজ৷ তখন পাড়ার কচিকাঁচাদের আনন্দের সীমা থাকত না৷ নাওয়াখাওয়া ভুলে আমরা ভিড় জমাতাম পুজো মণ্ডপে, চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতাম শুভারম্ভের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ঠাকুরের খড়ের কাঠামো তৈরি, একমেটে, দোমেটে, রং লাগানো, সাজপোশাক পরানো, আর সবশেষে মণ্ডপসজ্জার কাজ৷ চান খাওয়ার হুঁশ থাকত না৷ ফলস্বরূপ ঘরে ফিরেই পিঠে পড়ত মায়ের 'আদর'৷ হাতের আঙুলে লাগা মায়ের কঞ্চির ঘায়ের সেই দাগ এখনও আছে৷
তখন আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময়, যা আমার শিশুমনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, দাগ রেখে গিয়েছে সারা জীবনের মত৷ সে বছর দশমীর দিন সন্ধ্যায় বসেছিল ‘রামায়ণ’ যাত্রার আসর। বিকেল থেকেই সবার সঙ্গে লড়াই করে আমি সামনের দিকে নিজের আসন পাকা করে ফেলেছিলাম, লক্ষ্য রেখেছিলাম যাতে সেটি বেদখল হয়ে না যায়। যাত্রা আরম্ভ হওয়ার একটু আগে হঠাৎ গোপাল বলল, “এই চরণ, রাম রাবণ শূর্পনখা কেমন সাজছে একটু দেখতে যাবি?”
আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললাম, “চল৷”
দু’জনে উঠে গিয়ে সাজঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম ভিতরে সবাই কেউ কাঠের চেয়ারে, কেউ বা উঁচু জলচৌকির উপরে বসে একহাতে আয়না ধরে মুখে রং লাগাচ্ছে। দরজার ফাঁক দিয়ে দু’জনে ঠেলাঠেলি করে দেখতে দেখতে হঠাৎ পাল্লা দু’টো সশব্দে খুলে যেতেই আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে, গোপাল আমার পিঠের উপর৷ সে উঠেই দৌড়ে পালাল, কিন্তু আমি পারলাম না। যে লোকটা রাম সেজেছিল সে এগিয়ে এসে আমাকে হাত ধরে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, “লাগেনি তো বাবা?”
“না” বলে কাঁচুমাচু মুখে আমি কনুই দু’টো ঘসতে লাগলাম, কপালটাও জ্বালা করছিল। লোকটা আমার কপাল আর কনুই ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে দেখে ভিতরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসিয়ে ব্যাগ থেকে বোরোলিন বের করে লাগিয়ে দিল। তারপর আমার কী নাম, কোথায় থাকি, কী পড়ি, এই সব জিগ্গেস করতে লাগল৷ আমি ধীরেধীরে জড়তা কাটিয়ে উত্তর দিতে লাগলাম। শেষে লোকটা আমার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে বলে দিল যেন কাল সকালে একবার এসে কেমন থাকি বলে যাই। আমি ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এসে আবার বসে পড়লাম যাত্রা দেখতে৷
যাত্রা দেখে ঘরে এসে শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল৷ আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসেছিল কে জানে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে উঠে দেখি সূর্য অনেকটা উঠে গেছে। দৌড়ে জমিদারবাড়িতে গিয়ে দেখি যাত্রার দলের সবাই জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করে চলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে, কাল যে লোকটা রাম সেজেছিল সে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে৷ আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকল। কাছে যেতে, “তোমারই অপেক্ষা করছিলাম বাবা। কেমন আছ, হাতে আর ব্যথা নেই তো? দেখি।” বলে আমার হাতের কনুই আর কপাল দেখতে লাগল৷ হঠাৎ হাতের ওপর জলের ফোঁটার মত কিছু পড়তে আমি মুখ তুলে দেখি লোকটার চোখ জলে টলটল করছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কাকু, কাঁদছো কেন? আমার তো কিচ্ছু হয়নি, ব্যথাও প্রায় নেই।”
“দাঁড়া”, বলে লোকটা ভিতরে গিয়ে ব্যাগ থেকে বোরোলিন এনে আমাকে কোলে বসিয়ে লাগিয়ে দিয়ে বলল, “জানিস, তোর মত আমার একটা ছোট্ট ফুটফুটে ছেলে ছিল৷ কিন্তু ভাগ্যদোষে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷” তারপর তার কাহিনি শুনে কেঁদে উঠেছিল আমার মন৷
পশ্চিমের এক গ্রামে তাদের বাড়ি৷ বাড়িতে আছে বউ আর বিধবা মা৷ একটা ছোট্ট ফুটফুটে ছেলেও ছিল, কিন্তু এখন আর নেই, কিছুদিন আগে মারা গেছে৷ অল্প চাষের জমি আছে, কিন্তু লাল কাঁকুড়ে মাটিতে ফসল তেমন হয় না৷ সে যাত্রা করে সামান্য যা আয় করে তাই মিলিয়ে কোনও রকমে সংসার চলে৷ যাত্রার জন্যে তাকে বছরের বেশির ভাগ সময়টাই বাইরে কাটাতে হয়, দু’তিন মাস অন্তর ঘরে যায়৷ অভাবের সংসারে একটু খুশির ছোঁয়া এনেছিল ঐ ছোট্ট ছেলেটি৷ সারাদিন নেচে-কুঁদে হৈ-হুল্লোড় করে গোটা ঘর মাতিয়ে রাখত৷ যাত্রাপালা সেরে দু’তিন মাস পরে বাড়ি ফিরলে ছুটে এসে কোলে লাফিয়ে উঠত, আদর করে গলা জড়িয়ে ধরত। আর বাড়ি থেকে চলে আসার সময় গলা জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিত, কিছুতেই ছাড়তে চাইত না।
একবার গ্রামে খুব আন্ত্রিকের প্রকোপ হয়েছিল, বেশ কয়েকজন মারাও যায়৷ গ্রামে তেমন ডাক্তারপাতি নেই, হাসপাতাল অনেক দূরে, যানবাহনেরও অভাব, সহজে যাওয়া যায় না৷ গ্রামে হাতুড়ে যতীন ডাক্তারই ভরসা, আপদে-বিপদে সবাই তার কাছে ছুটে যায়৷ কিন্তু লোকটা চশমখোর, একটা পয়সাও ছাড়ে না৷ আন্ত্রিক তাদের ঘরেও ঢুকল, ধরল ছেলেটাকে৷ মা-ঠাকুমা গিয়ে যতীন ডাক্তারের কাছে পড়ল, কিন্তু সে আগেকার পাওনা টাকা না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই ওষুধ দিতে রাজী হল না৷ অবশেষে অনেক হাতে পায়ে ধরে একদিন পরে যখন সে খোকাকে দেখতে এল, তখন তার শেষ অবস্থা, সেদিনই সন্ধ্যায় চলে গেল ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে৷ সে তখন ছিল যাত্রার দলের সঙ্গে ভিন জেলায়৷ খবর পেয়ে যখন ঘরে এল সব শেষ। পুত্রশোকে মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল৷ পাগলির মত ঘুরে বেড়ায়, ছেলের বয়সী পাড়ার শিশুদের কাউকে দেখলে ‘খোকা’ ‘খোকা’ বলে ধরতে যায়৷ বুড়ি মায়ের শরীরের অবস্থাও ভাল নয়, প্রায় শয্যাশায়ী৷ অথচ তারও বাড়ীতে থাকার উপায় নেই৷ গ্রামে তেমন কাজকর্ম নেই, তাই রোজগারের ধান্দায় বাইরে যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই৷ মনটা কিন্তু বাড়ীতেই পড়ে থাকে৷
চোখের জল মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটা বলল, “জানিস, সে ছিল ঠিক তোর মত দেখতে৷ তোরই মত চেহারা, ছিপছিপে গড়ন, ফর্সা। কাল তোকে দেখে মনে হয়েছিল, বুঝি আমার খোকাকে দেখছি।”
আমার চোখ দু’টোও ছলছল করছিল। কাকুর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম, “কেঁদো না কাকু, আমাকে যখনই মনে পড়বে চলে এসো।” শেষে আমার কাছে বিদায় নিয়ে যাত্রাদলের অন্যান্য লোকেদের সঙ্গে লোকটা গরুর গাড়িতে উঠে বসল। জলভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, “ভাল থেকো বাবা, বেশী দুষ্টুমি কোরো না৷ মায়ের কথা শুনো, আর ভাল করে লেখাপড়া কর৷”
“ঠিক আছে কাকু, আবার এসো কিন্তু” বলে হাত নাড়তে নাড়তে আমি গাড়ির পিছন পিছন খানিকটা দৌড়ে গেলাম৷ তারপর যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে রইলাম তাদের গাড়ির দিকে।
লোকটার সেই জল চলটল চোখ আজও আমি ভুলতে পারিনি৷ সেদিন রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নগুলো এখনও মনকে নাড়া দিয়ে যায়, যার উত্তর আমি আজও খুঁজে পাইনি—ডাক্তারের কাজ তো ওষুধ দিয়ে আমাদের প্রাণ বাঁচানো৷ তাহলে কোনও কোনও ডাক্তার টাকা না পেলে ছোট্ট খোকা মরে যাচ্ছে দেখেও ওষুধ দেয় না কেন মা? কারও ঘরে খাবারের অভাব নেই, আবার কেউ খেতে পায় না কেন? ছোট্ট খোকাকে ভগবান মায়ের কোল থেকে কেড়ে নেয় কেন? মা দুর্গা এত নিষ্ঠুর কেন মা?
প্রতিবেদক: লেখক ও গবেষক
Disclaimer: এই প্রতিবেদন লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব মত। bangla.aajtak.in দায় নিচ্ছে না।