দা মাউন্টেনম্যান দশরথ মানঝির কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়। বিহারের এই সন্তান একা হাতে আস্ত পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছিলেন। সময় নিয়েছিলেন ২২ বছর। কম যান না মুর্শিদাবাদের কান্দির প্রভাত করও। পাহাড় কাটেননি তিনি ঠিকই। তবে নিজের শহরে রেল আনার জন্য টানা ৩০ বছর আন্দোলন করেছেন। সফলও হয়েছেন খানিকটা। তবে স্বপ্নপূরণ হওয়া দেখে যেতে পারলেন না। তার আগেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত কান্দি তথা মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ।
গত এক মাস ধরে জ্বরে ভুগছিলেন প্রভাত কর। জ্বর শরীরেই অবিরাম কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, শরীর সাথ দেয়নি তাঁর। গত ২৫ এপ্রিল কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে কোনওরকম খামতি রাখেননি লড়াকু প্রভাতবাবু। তবে হার মানতে হয়। ৯ মে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
অনেকেই বলছেন, প্রভাত করের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় শেষ হয়ে গেল কান্দিবাসীর রেলের স্বপ্ন। কারণ, সেই ১৯৯২ সাল থেকে রেলের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন তিনি। গড়ে তুলেছিলেন কান্দি রেলওয়ে সংযুক্তকরণ কমিটি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কান্দিতে রেল আনার দাবিতে পাড়ি দিয়েছিলেন দিল্লি, কলকাতা সর্বত্র। গত ৩ দশকে দাবি আদায়ে ধর্না, অবস্থান বিক্ষোভ, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে খোলা চিঠি পাঠানো, রিলে অনশন, রাজভবনে দরবার, রেলমন্ত্রকের আধিকারিকদের কাছে আবেদন, কী না করেননি।
বিভিন্ন সময় আন্দোলনের গতি শ্লথ হয়েছে। এখানে সেখানে ঘুরেও আশ্বাস পাননি। তবে হাল ছাডে়ননি। যতবার ব্যর্থ হয়েছেন, নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। ফের আন্দোলনে গতিদান করেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ এমনও দৃশ্য দেখেছে, একাই মাইক হাতে রেলের দাবিতে রাস্তায় বক্তব্য রাখছেন তাদের প্রভাতদা।
যা দেখে অনেকেই হাসাহাসি করেছেন। পিছনে কথা বলেছেন। কিন্তু, থেমে থাকেননি প্রভাত কর। আন্দোলনের দাবিকে মান্যতা দিয়ে ২০০৯ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কান্দির উপর দিয়ে নতুন রেল লাইনের কথা ঘোষণা করেন। পূর্বরেলের কাটোয়া-আজিমগঞ্জ শাখার চৌরিগাছা স্টেশন থেকে সাঁইথিয়া স্টেশন পর্যন্ত ওই রেল লাইন হওয়ার কথা ছিল। পরের বছর ওই রেল পথের অনুমোদন দেয় রেল বোর্ড। ২০১১-২০১৩ সালের মধ্যে ৫৭.৫০ কিলোমিটার লম্বা ওই রেলপথ তৈরির জন্য সমীক্ষাও হয়।
কিন্তু, কান্দিতে রেলপথ তৈরির সমীক্ষা হলেও জমিজটে আটকে আছে কাজ। আরও বড় সমস্যা হল, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের রেলের পিঙ্কবুকে কান্দির রেলপথের বাজেটে বরাদ্দের কথাও নেই।
তবে আশা ছাড়ার লোক ছিলেন না প্রভাত কর। পিঙ্কবুকে নাম নেই দেখে বলেছিলেন, 'আমরা আন্দোলন আরও জোরদার করব। রাজ্যপালের কাছে যাব। কেন্দ্রের কাছে রেলের বরাদ্দের দাবি জানাব।' জানিয়েওছিলেন। ছুটে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের কাছে। তাঁর হাতে কান্দির রেলের দাবি সম্বলিত পত্র তুলে দিয়েছিলেন। রাজ্যপাল তাঁকে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু, তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। রেল আনার সেই স্বপ্নপূরণ করার আগেই কোভিড কেড়ে নিল তাঁর প্রাণ।
কান্দি রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'প্রভাত কর তো একটি অধ্যায়ের নাম। অজাতশত্রু। রেলের দাবিতে তিনি কী না করেছেন? এমন মানুষ কমই দেখেছি। তাঁর উদ্যোগ প্রশংসা করার মতো।'
কান্দির সমাজকর্মী কৌশিক সেনগুপ্তের কথায়, 'প্রভাত কর শুধু রেলের দাবিতেই আন্দোলন করেননি। ক্যারাটে ক্লাব, রেড ক্রশ-সহ বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। তবে তাঁর হাত ধরেই কান্দির মানুষ রেলের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল। প্রভাত কর যেন বিহারের দশরথ মাঝি। মাউন্টেনম্যান। উনি সাফল্য দেখে যেতে পেরেছিলেন। প্রভাতদা রেল দেখে যেতে পারলেন না। এই পার্থক্য।'
তাহলে কি প্রভাত করের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে কান্দিতে রেল আসার স্বপ্ন? এই প্রশ্নই এখন সবথেকে বেশি ভাবাচ্ছে এলাকাবাসীকে। যদিও স্থানীয় সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই প্রভাত করের আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছেন কয়েকজন। এখন দেখার সত্যিই কি তাঁরা বাংলার 'দশরথ মাঝি' প্রভাত করের স্বপ্নকে পূরণ করতে পারবেন? ভবিষ্যতই দেবে এই প্রশ্নের উত্তর।