কোটা বিরোধী আন্দোলনের চাপে পড়ে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে আসতে হয়। সেদিন হাসিনার বাড়িতে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। তারপর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সেই দেশে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের মনোভাবও হাসিনার প্রতি নরম নয়। ফলে হাসিনার পক্ষে বাংলাদেশ ফেরা এখন নিরাপদ নয়। এদিকে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপর চাপ বাড়ছে। কারণ ইতিমধ্যেই কোটা বিরোধী আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগ উঠেছে মুজিবুর কন্যার উপর। বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর থেকে হাসিনা ভারতের একটি সেফ হাউসে লুকিয়ে আছেন। প্রায় দেড় মাস পর তাঁর প্রত্যর্পণকে আইনি রূপ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিশেষ শাখা।
বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করানোর বিষয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের উপর হামলার ঘটনায় হাসিনাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে তদন্তও করছে সেই ট্রাইবুনাল। প্রসঙ্গত, প্রায় ১৫ বছর আগে হাসিনা সরকারের আমলেই এই ট্রাইবুনাল স্থাপিত হয়। এখন সেই সংস্থা হাসিনার বিরুদ্ধে কাজ করছে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল তৈরি করে। এর কাজ ছিল দেশের স্বাধীনতার সময় সংঘটিত হিংসার জন্য দায়ীদের শাস্তি দেওয়া। যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের দায়িত্বও ছিল সেই আদালতের উপর।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা মামলা করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল শিরোনামে চলে এসেছিল। বার্গম্যান যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত কার্যক্রমের বিষয়ে আদালতের ভূমিকা নিয়ে কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই নিবন্ধে তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের আদালত অনেক ভুল তথ্য দিয়েছে। তখন তাঁকে মোটা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। ডেভিডের আগেও বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক কোর্টের রোষানলে পড়েছিল।
তবে এই প্রথম হাসিনার মামলায় বিচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে এই ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল। গত জুলাই মাসে বিক্ষোভ চলাকালীন চারশোর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে খবর। অগাস্টেই রাষ্ট্রসংঘের একটি দলও ঢাকায় গিয়ে এর তদন্ত করেছে। এত জনের মৃত্যুর সত্যতা যদি পাওয়া যায় তাহলে স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে হাসিনার উপর চাপ বাড়তে পারে। হাসিনাকে ফেরানোর জন্য চাপ আসতে পারে ভারতের উপরও।
ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি
২০১৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, উভয় দেশকে অপরাধীদের একে অপরের হাতে তুলে দিতে হবে। প্রত্যর্পণ চুক্তির কারণে, বাংলাদেশ ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। অনুপ চেটিয়া অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা ছিলেন।
এই প্রত্যর্পণ চুক্তিতে বিধান রয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি যদি এমন কোনও অপরাধ করে থাকে যার কমপক্ষে এক বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে, তাহলে তাকে প্রত্যর্পণ করা হবে। চুক্তিতে লেখা আছে, কোনও ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক অপরাধ করে থাকে তাহলে তার প্রত্যর্পণও প্রত্যাখ্যান করা যাবে। তবে হত্যা, গণহত্যা ও অপহরণের মতো অপরাধে জড়িত ব্যক্তির প্রত্যর্পণ অস্বীকার করা যাবে না।
দুই দেশের মধ্যে চুক্তির ১০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে দেশটি অনুরোধ করে সেই দেশের কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করাই যথেষ্ট। তার জন্য অভিযোগ প্রমাণের কোনও প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য, কোনও ব্যক্তি রাজনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত হলে সে বলতে পারে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য তার উপর খাঁড়া নামানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যে দেশ আশ্রয় দিয়েছে সে ফেরাতে নাও পারে। তবে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির অনুচ্ছেদ ২১(৩) অনুযায়ী উভয় দেশ চুক্তিটি বাতিল করতে পারে। এমনকী একটি দেশ একতরফাভাবেও তা করতে পারে। তবে এই চুক্তি প্রত্যাহার করা কোনও একটি দেশের পক্ষে খুব বড় পদক্ষেপ। তেমন কিছু সত্যিই হলে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কে সরাসরি প্রভাব পড়বে। এখন দেখার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল কী পদক্ষেপ নেয় ও ভারতের অবস্থান হয়।