সোমবার অনলাইনে সবচেয়ে বেশি ট্র্যাক হওয়া উড়ানের তালিকায় এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি বিমান। সেই বিমানেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আসছিলেন শেখ হাসিনা। হঠাৎ, খুব স্বল্প সময়ের নোটিশেই ভারতে আশ্রয়ের আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি। মঙ্গলবার এমনটাই জানিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
কিন্তু এই হঠাৎ সিদ্ধান্ত... দ্রুত, বিশেষ কনভয়ে এসে হেলিকপ্টারে চড়া, তারপর বিমান... কীভাবে শেষ মুহূর্তে এত তাড়াতাড়ি সব কিছু করলেন শেখ হাসিনা?
বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা বলছেন, শেখ হাসিনা মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যেই পুরো সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। নিজের কাছের পরামর্শদাতা-আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের আগে কয়েক ঘণ্টা ধরে বোঝানো, ফোন কল ও মিটিং হয়েছে।
ঢাকার সংবাদপত্র প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশ থেকে পালানোর আগে, সোমবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে মিটিংয়ে বসেন হাসিনা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন আইনপ্রণেতা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে গভীর বৈঠক হয়।
কিন্তু ততক্ষণে, গণভবনের দিকে ঢাকা মার্চ শুরু করে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ঢাকায় আসার প্রায় সমস্ত রাস্তাতেই রেকর্ড ভিড়। যতদূর চোখ যায়, শুধুই মানুষ আর মানুষ।
গত রবিবার এক দিনে প্রায় ৯৮ জন বাংলাদেশির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেই এই ঢাকা চলোর সিদ্ধান্ত নেয় আন্দোলনকারীরা।
এমনই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও বল প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করছিলেন হাসিনা।
কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে সেই চেষ্টায় কোনও লাভ হয়নি। সশস্ত্র বাহিনী এবং তাঁর দলের কর্মীদের ব্যবহার করেও ছাত্র বিক্ষোভ এবং ব্যাপক অস্থিরতার গনগনে আঁচে সামান্য জলটুকুও ঢালতে পারেননি।
একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতাই প্রথমে সরকার ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রবিবার রাতেই তাঁকে সামরিক বাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি করনোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা।
তবে, সেই মুহুর্তে, তিনি পরামর্শ মানতে নারাজ ছিলেন।
উল্টে হাসিনা সোমবার থেকে কঠোর কার্ফুর আদেশ দিয়ে দেন। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ সহ বাংলাদেশে প্রায় সবকিছুই বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন।
এরপর সোমবার ভোরবেলা থেকে কার্ফু জারি করার চেষ্টা সত্ত্বেও, বিক্ষোভকারীরা সকাল ৯টা নাগাদ বিভিন্ন স্থানে তা অমান্য করতে শুরু করে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঢাকার রাজপথে নেমে আসে লাখ-লাখ মানুষ।
বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান এবং পুলিশের আইজিপি-কে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, গণভবনে তলব করা হয়।
শেখ হাসিনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। প্রশ্ন তোলেন যে, তাঁরা কেন সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া যান নিয়ে, আরও কঠোরভাবে আন্দোলনকারীদের রুখছে না।
এর উত্তরে পুলিশের আইজিপি জানান, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে, পুলিশের পক্ষে এতদিন ধরে এমন কঠোর অবস্থান বজায় রাখা আর সম্ভবই ছিল না। বাকি কর্তারাও হাসিনা বোঝান যে, এখন শুধু বলপ্রয়োগ করে আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তা কিছুতেই মানতে চাইছিলেন না বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
বোন, ছেলের ফোনে হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়তে রাজি হলেন
হাসিনাকে বোঝাতে না পেরে, তারপরেই কয়েকজন আধিকারিক তাঁর ছোট বোন রেহানার সঙ্গে আলাদা করে দেখা করেন।
তাঁরা তাঁকে পরিস্থিতিটা বোঝান। দিদিকে বিষয়টা বোঝাতে অনুরোধ করেন।
শেখ হাসিনা তখনও দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
এর পরে, একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক শেখ হাসিনার বিদেশে থাকা ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জয় তারপর তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। পুরো বিষয়টা ভাল করে বোঝান। এর পরেই তিনি পদত্যাগ করতে রাজি হন।
জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা রেকর্ড করারও সময় নেই
হাসিনা রাজি হতেই তোড়জোড় শুরু করে দেন নিরাপত্তাকর্মীরা। এদিকে দেশ ছাড়ার আগে জাতির উদ্দেশে একটা ভাষণ রেকর্ড করবেন বলে জানান শেখ হাসিনা। কিন্তু সরকারি আধিকারিকরা জানান, সেটা করতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। আপাতত সময় থাকতে বেরিয়ে যাওয়াই ভাল।
ততক্ষণে, শাহবাগ ও উত্তরার দিক থেকে অসংখ্য আন্দোলনকারী গণভবনের দিকে মিছিল করে এগিয়ে এসেছে। সেনাকর্তারা হাসিনাকে জানান, তাঁর হাতে রেডি হওয়ার জন্য মাত্র ৪৫ মিনিট আছে।
শেখ হাসিনা তার ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তাঁর সরকারি বাসভবন সংলগ্ন তেজগাঁও বিমান ঘাঁটির হেলিপ্যাডে পৌঁছান। তাঁর কিছু জিনিসপত্র আগে থেকেই বোঝাই করা ছিল।
শেখ হাসিনা তারপরে রাষ্ট্রপতির বাড়ি বনভবনে যান। সেখানে তিনি তাঁর আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারটি, শেখ হাসিনা ও তাঁর বোনকে নিয়ে ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশের পরপরই আগরতলায় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হেলিপ্যাডে অবতরণ করে।
এরপরে, শেখ হাসিনা ভারতীয় সময় বিকাল ৫.৩৬ মিনিটে নয়াদিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছান। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সহ ভারতীয় আধিকারিকরা তাঁকে রিসিভ করেন।
শেখ হাসিনার প্রস্থান, শুধু ১৫ বছরের একটি যুগের সমাপ্তিই নয়, বাংলাদেশের জন্য একটি অনিশ্চিত, আবার আশাব্যঞ্জক অধ্যায়ের সূচনাও হতে পারে। অনেকে বলেন, শূন্যতাই সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। হয় তো এক্ষেত্রেও সেই স্বপ্নই দেখছেন আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা।